শরিফুল হাসান
আশুলিয়ায় একজন কলেজ শিক্ষককে পিটিয়ে হত্যা করেছে দশম শ্রেণীর এক ছাত্র। নিহতের পরিবার ও অন্যরা বলছে, বিভিন্ন সময় শাসন করায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওই বখাটে ও উচ্ছৃঙ্খল ছাত্র ওই শিক্ষককে ব্যাট দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে।
হাসপাতালে নেয়ার পর তাঁর মৃত্যু হয়। ওদিকে নড়াইলে এক অধ্যক্ষকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরানো হয়েছে। ঘটনাগুলো ভীষণ পীড়াদায়ক। আসলে একটা দেশ কতোটা সভ্য সেটা কখনোই অর্থনীতি বা টাকা পয়সার ওপর নির্ভর করে না, করে তার মানবিক মূল্যবোধের ওপর। আর এই মূল্যবোধে দিনকে দিন আমরা তলানিতে নামছি।
আশুলিয়ার ঘটনাটা তো ভীষণ ভয়ঙ্কর। নিহত শিক্ষক উৎপল গত ১০ বছর ধরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের কলেজ শাখার রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক এবং শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।গণমাধ্যমকে কলেজের অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান জানান, প্রতি বছর ছেলেদের ফুটবল ও মেয়েদের ক্রিকেট টুর্নামেন্টের আয়োজন হয়।
এবারও এই আয়োজন করা হয়েছিলো। শনিবার মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিলো। শিক্ষক উৎপল খেলা চলাকালীন মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ দশম শ্রেণীর এক বখাটে ছাত্র সেখানে গিয়ে ওই শিক্ষকেকে স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। পরে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই আজ ভোর সোয়া ৫টার দিকে মারা যান ওই শিক্ষক।
পুলিশ ও কলেজ শিক্ষকরা বলেছেন, নিহত শিক্ষক উৎপল প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা কমিটির সভাপতি হিসেবে ছাত্রদের আচরণগত সমস্যা নিয়ে কাউন্সেলিং করতেন তিনি। অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিচারও করতেন। বখাটে ওই ছাত্র মেয়েদের প্রায় উত্যক্ত করতো। এ কারণে ওই শিক্ষক তাকে কয়েক দফায় শাসন করেছে। সেই ক্ষোভেই হয়তো এই কাজ করেছে। পুলিশ বলেছে মামলা হয়েছে। আসামিকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। আমি শুধু ভাবছি একজন শিক্ষককে সবার সামনে যখন পেটানো হয় তখন বাকিরা কী করছিল?
কেউ প্রতিরোধ করতে আসেনি? অবশ্য নড়াইলের ঘটনা দেখলে দেখা যাবে সেখানে সবাই মিলে আরেকটি কলঙ্কজনক ঘটনা ঘটিয়েছে। সেখানেনড়াইলের মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়েছে স্থানীয়রা। গণমাধ্যম বলছে, ভারতের বিজেপি নেত্রী নূপুর শর্মার ছবি দিয়ে ফেসবুকে গত ১৭ জুন নড়াইলের এক কলেজ ছাত্র পোস্ট দেয়। পরদিন ওই ছাত্র কলেজে গেলে কিছু মুসলমান শিক্ষার্থী তাকে পোস্ট মুছে ফেলার জন্য বলে।
এরই মধ্যে ‘‘অধ্যক্ষ ওই ছাত্রের পক্ষ নিয়েছেন’’ এমন কথা রটানো হয়। এই কথাকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয় এলাকায়। স্থানীয়দের একটি পক্ষ অধ্যক্ষ ও দুজন শিক্ষকের মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয়দের সঙ্গে তাদেরও সংঘর্ষ হয়। ওই সময় ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে মির্জাপুর ইউনাইটেড কলেজের ছাত্র ও স্থানীয়রা ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে তাকে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করে। ঘটনার কিছু ছবি এবং ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। চূড়ান্ত হেনস্তার বর্ণনা দিয়ে শিক্ষক স্বপন কুমার বলেন, ‘পুলিশ আমাকে কলেজ কক্ষ থেকে বের করে আনে। তখন দুই পাশে শত শত পুলিশ ছিল।
এর মধ্যেই স্থানীয়রা আমাকে পুলিশের সামনেই জুতার মালা পরিয়ে দিল। আমাকে পুলিশ ভ্যানের কাছে নেয়ার সময় পিছন থেকে অনেকে আঘাত করেন। আমি মাটিতে পড়ে যাওয়ায় পায়ের কিছু জায়গায় কেটে যায়। তখন অনুভব করি পিছন থেকে কেউ আমার মাথায় আঘাত করছে।’এই ঘটনার পর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন স্বপন কুমার বিশ্বাস। গত এক সপ্তাহে তিনবার ঠিকানা বদল করেছেন তিনি।
আফসোস করে গণমাধ্যমে বলেছেন, ‘৩০ বছর ধরে আমি এই কলেজে শিক্ষকতা করি। ছাত্ররা আমার প্রাণ, স্থানীয়রাও আমাকে ভালোবাসত। তবু আমার সঙ্গে যা ঘটে গেল, এরপর এই মুখ নিয়ে কী করে আমি কলেজে যাব’।
আচ্ছা ওই অধ্যক্ষের অপরাধটা কী? একদল ছাত্র যখন তাঁকে গিয়ে জানাল কলেজের একজন হিন্দু ছাত্র ভারতের নূপুর শর্মার পক্ষে পোস্ট দিয়ে ধর্ম অবমাননা করেছে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার তখন থানা পুলিশে ফোন করেন। কেন তিনি ফোন করলেন? এই ফোন করাই অপরাধ? এই ফোন করাটাই ধর্ম অবমাননা? এ কারণে রটিয়ে দেওয়া হবে শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাস ছাত্রের পক্ষ নিয়েছে?
তারপর সবার সামনে পুলিশ-প্রশাসনের উপস্থিতিতে তাকে জুতার মালা গলায় পরিয়ে ভিডিও করা হবে?একবার ভাবুন কী ভয়ানক ঘটনা! এই দেশে আমরা শিক্ষকদের এমনিতেই যথাযথ মর্যাদা দেই না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সরকারি পিয়নদের চেয়েও কম বেতন পায় অনেক সময়।
এতো কিছুর পরেও একদল মানুষ শিক্ষকতা করেন। এখন তাদের পেটানো হবে, জুতার মালা পরানো হবে? হিন্দু বলেই কী আরেকটু বেশি অত্যাচার? বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষক উন্মেষ রয় এবং সঞ্জয় সরকার, মুন্সীগঞ্জে হদয় মণ্ডল, তারও আগে শ্যামলকান্তির এসব ঘটনাগুলো কী ইঙ্গিত দেয়?
আচ্ছা শিক্ষকদের বিশেষ করে হিন্দু শিক্ষকদের অপমান কী শুধুই বিচ্ছিন্ন ঘটনা? দিনের পর দিন সিলেবাস বদল, কথায় কথায় হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলা, মামলা সবকিছুর যোগসূত্র আছে নিশ্চয়ই।নীতিনির্ধারকদের বলবো ব্যবস্থা নিন। যারা কথায় কথায় শিক্ষকদের গায়ে হাত তোলে, অপদস্থ করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিন। আর এই রাষ্ট্রের প্রতিটি মানুষকে বলবো চলুন শিক্ষকদের সম্মান দিতে শিখি। মনে রাখবেন মূল্যবোধের যে পতন হচ্ছে সেটা ঠেকাতে না পারলে আমাদের পতন অনিবার্য।


