শরিফুল হাসান
দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল! চারপাশে যখন দেখি মূল্যবোধের অবক্ষয়, অমানবিকতা, নীতিহীন চর্চা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা, ব্যক্তিগত স্বার্থের প্রাধান্য, সর্বোপরি সত্যিকারের মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হয়; তখন এই ভেবে কিছুটা হলেও মানসিক শান্তি পাই যে অন্ততপক্ষে মানুষ হওয়ার চেষ্টাটা করছি। এই যে নিজেকে আমি মানুষ মনে করছি, এই মানুষ হওয়ার পেছনে যে কয়টি প্রতিষ্ঠান এবং মানুষের অবদান আছে তাদের অন্যতম আমার স্কুলশিক্ষক প্রণয় কান্তি নাথ। স্যার ছিলেন আমাদের সময়ের এক আলোকবর্তিকা। আমাদের মানে যারা একসময় চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম।
১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর পৃথিবী ছাড়ার আগ পর্যন্ত স্যার ছিলেন এই স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক। কিন্তু শুধু ইংরজেি নয়, স্যার আমাদের মানুষ হওয়ার শিক্ষাটা দিতে চেয়েছিলেন আজীবন। স্যার সারাজীবন স্কুলে শিক্ষকতা করতে চেয়েছেন শুধু পেশার কারণে নয় নেশার কারণে। শিক্ষক বাবার সন্তান আমাদের স্যার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে অনার্স পাস করে আজীবন শিক্ষকতা করেছেন।

আমি আমার সারাজীবনে এমন মেধাবী, মানবিক, সৃজনশীল ছাত্র অন্তপ্রাণ শিক্ষক খুব বেশি পাইনি। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় তিনশ কিলোমিটার দূরের এক স্কুলের শিক্ষক প্রণয় স্যারের জানার বা পড়ার কোন শেষ ছিলো না।আমার দেখা সত্যিকারের বড় মানুষদের একজন ছিলেন স্যার। যতোবার গিয়েছি মনে হয়েছে বড় থেকে বড় মানুষ। ক্লাস ফাইভে পড়া অবস্থায় এই আমার হাতে দেশি বিদেশি সব গল্প উপন্যাস প্রবন্ধ তো স্যারই তুলে দিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ, দেশ, মানুষ, মেয়েদের সম্মান, মানুষের পাশে দাঁড়ানো কী শেখাননি স্যার। গত ত্রিশ বছরে স্যার শত শত ছেলেমেয়েকে আলোকিত করেছেন। তাদের কেউ ডাক্তার, কেউ প্রকোশলী কেউ বড় সরকারি কর্মকর্তা, কেউ কানাডা আমেরিকায় প্রবাসী। কিন্তু স্যার সেই সাদামাটা জীবনটাই যাপন করে গেছেন। স্যার ক্লাসে পড়াতেন অসম্ভব মমতা দিয়ে।
আমাদের স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ আরো অনেকেই বেত ব্যাবহার করতেন দুষ্ট ছাত্রদের সামলাতে। কিন্তু আমরা কোনদিন প্রণয় স্যারকে ক্লাসে বেত ব্যাবহার করতে দেখিনি। কোন ছাত্রের গায়ে হাত তুলতে দেখিনি। তবুও স্যারের ক্লাসে স্কুলের সবচেয়ে দুষ্টু গুণ্ডা প্রকৃতির ছেলেটাও কোন দুষ্টুমি করতো না শ্রদ্ধায়। স্যারের ধমককে, স্যারের অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্বকে প্রচণ্ড শ্রদ্ধা করতো সবাই। আগেই বলেছি, ইংরেজির শিক্ষক হলেও তিনি আসলে ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা। স্যার তাঁর মমতা দিয়ে, কেবল লেখাপড়াই শেখাননি শিখিয়েছেন সত্যিকারের মানুষ হওয়ার দর্শন।
আমরা তাকে দার্শনিকও বলতাম।মায়ের কারণে ছোটবেলা থেকেই গল্পের বই পড়ার অভ্যাস ছিলো। স্যার সেটাকে বাড়িয়ে দিলেন বহুগুণে। মাধ্যমিকের গণ্ডি শেষ করার আগেই সুনীল, শীর্ষেন্দু, সমেরশ, জয় গোস্বামী, বিজ্ঞান, যুক্তি, ধর্ম নিয়ে নানা ধরনের বই, তসলিমা এমনকি হুমায়ুন আজাদ পর্যন্ত পড়া হয়ে গেলা আমার। বাদ থাকলো না আরজ আলী মাতুব্বর কিংবা ব্রাটন্ড রাসেলও। স্যারনিজের লেখা কবিতা পড়াতেন। বলতেন তার নিজের দর্শণের কথা। শুধু একটা কথাই বারবার বলতেন জীবনে যাই করো না কেন, সত্যিকারের মানুষ হও। আমি জানি না স্যারকে আমি বেশি ভালোবাসতাম না স্যার আমাকে। আমার প্রতি স্যারের ভালোবাসাটা ছিলো অনেক বেশি।
এতো সব সফল যোগ্য শিক্ষার্থীদের রেখে সব ব্যাচের ছেলেমেয়েদের স্যার আমার কথা বলতেন! স্যারের দাবি ছিল, যে কয়জনকে তিনি মানুষ বানাতে পেরেছেন সেই তালিকায় আমি সবার ওপরে। এই ছাত্রদের সঙ্গে পরে কখনো দেখা হলে ওরা আমাকে বলতো আপনিই শরিফুল হাসান ভাই? স্যার যে কতো গল্প করতেন আপনার। স্যারের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা প্রায় তিন দশকের। আমি যখন পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র স্যার তখন আমাদের ক্লাস ফাইভে ইংরেজি পড়াতেন। স্যারের কারণেই ইংরেজিটা আমার কাছে বাংলার চেয়েও সহজ মনে হতো। ইংরেজি পরীক্ষার আগে জীবনে কোনদিন আমাকে পড়তে হয়নি। মাধ্যমিক পাস করে কলেজে ওঠার পর স্যার তো আমার বন্ধু হয়ে গেলেন।
কতো কতো বিষয় আমরা শেয়ার করেছি পরষ্পরের সঙ্গে। কতো কতো স্মৃতি! তবে ২০০০ সালের কথা বিশেষভাবে মনে থাকবে। আমি তখন কলেজে। হুট করেই একদিন শুনলাম স্যারের ক্যানসার। কোলন ক্যানসার। খুব শেষের দিকে। দেশের ডাক্তাররা স্যারকে পরামর্শ দিলেন ভারতে গিয়ে অপারেশন করানোর। দ্রুতই প্রস্তুতি নেয়া শুরু হলো। চট্টগ্রামে ভারতীয় হাইকমিশনে আমি গিয়েছিলাম স্যারের পাসপোর্ট নিয়ে। এরপর গেলাম মিরসরাই উপজেলার ডোমখালী গ্রামে স্যারের বাড়িতে।
শুনলাম স্যারের ছোটবেলার গল্প। স্যার ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছেন। মায়ের প্রচেষ্টায় বহু কষ্টে পড়ালেখা করেছেন। স্যারের খুব শখ ছিল বড় হয়ে গবেষক হবেন। কিন্তু অল্প বয়সে সংসারের হাল ধরতে গিয়ে সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। প্রতিষ্ঠিত গবেষক হতে না পারলেও প্রতিনিয়ত ভাষা নিয়ে গবেষনাধর্মী কাজ করছেন। ইংরেজী ভাষাকে শিশুকিশোরদের কাছে সহজ থেকে সহজতর করে উপস্থাপন করার চেষ্টা করছেন।স্যারের এই ক্যানসারের সময় আমি খুব ঘনিষ্ঠভাবে স্যারের সঙ্গে মিশেছি।
বঙ্গোপসাগেরর পাড়ে মেরিন ড্রাইভের রাস্তা ধরে আমরা তখন একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভিজেছি। কৃষ্ণচূড়া-শিমুল দেখেছি একসাথে। এই সময়ে আমিই যেন হুট করে স্যারের শিক্ষক হয়ে যাই। এরপর স্যার ভারতে গেলেন। কয়েক মাস পর স্যার ফিরলেন। তবে পুরোপুরি সুস্থ হলেন না। অবস্থা মাঝে মাঝে ভালো আবার খারাপ। ডাক্তাররা বলেই দিলেন, স্যার দু-এক বছরের বেশি বাঁচবেন না। আমি স্যারের কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করলাম। এর মধ্যেই আমি চলে এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্যারের সঙ্গে ফোনে কথা হয়। ঈদের ছুটিতে বাসায় গেলে আমার প্রথম কাজ হয় স্যারের সঙ্গে দেখা করা। খুব আশ্চর্য হয়ে দেখি ডাক্তাররা হার মানলেও স্যার হার মানেননি। নিজেই নিজের ডাক্তার হয়ে যান।
কোন ঔষুধ খেলে কেমন প্রতিক্রিয়া হয় সেটা দেখে নিজেই নিজের ঔষুধ বের করে ফেলেন। জেই নিজের খাবার রান্না করা শুরু করলেন। এই করে ১৭ টা বছর বেঁচে ছিলেন। ২০১৭ সালের আজকের দিনে স্যার আমাদের ছেড়ে চলে যান। স্যারের মৃত্যুর খবর শুনে আমি ঢাকা থেকে ছুটে গিয়েছিলাম চট্টগ্রামে। পুরোটা পথ আমি কেঁদেছিলাম।আমাদের স্যার খুব প্রচার বিমুখ মানুষ ছিলেন। শারিরিকভাবে দূর্বল হলেও সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে স্যারকে দেখতাম প্রতিবাদ করতে।
বিজয় বা স্বাধীনতা দিবসে স্কুলের অনুষ্ঠানে সারের কবিতা আমাদের চেতনা জাগাতো। স্যার স্বপ্ন দেখতেন বাংলাদেশ একদিন এগিয়ে যাবে। স্যারের চারটি বই, বুদ্ধির মুক্তি ও বেদনা মাধুরী, আকাশলীনার সাথে কিছুক্ষণ, অতঃপর মেঘের কাছে এবং প্রবচন প্রদীপন বইগুলোতে সেই ভাবনা অনেকখানি উঠে এসেছে। আমি সবসময় বলি আমার দেখা সত্যিকারের বড় মানুষদের একজন ছিলেন স্যার।
আমি খুব বিশ্বাস করি এরকম একজন শিক্ষক কারো জীবনে আসলে সে সত্যিকারের মানুষ হওয়ার চেষ্টা অন্তত করবে। স্যার আজ পাঁচ বছর হলো আপনি পৃথিবীতে নেই। কিন্তু আপনি বেঁচে থাকবেন আমার মতো হাজারো ছাত্রছাত্রীর অন্তরে। আমরা সারাজীবন বলবো আমাদের একজন প্রণয় স্যার ছিলেন। ছিলেন আমাদের আলোকবর্তিকা।