সুশাসনের ঘাটতি ভয়াবহ দুর্নীতি..

Spread the love

শরিফুল হাসান

যদিও সুশাসনের ঘাটতি আছে, যদিও ভয়াবহ দুর্নীতি আছে তারপরেও কৃষি, প্রবাসী শ্রমিক আর পোশাক খাতের শক্ত অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে কী না জানি না! না পড়ার সম্ভাবনাই বেশি! তবে এর চেয়েও বড় বিপদ হলো, ধর্মান্ধতার দিকে, মৌলবাদের দিকে আমাদের যে ট্রেন চলছে সেই গতিপথে চলতে থাকলে ভবিষ্যত খুবই সংকটাপন্ন। এই পতন ঠেকানো মুশকিল!

কয়েকটা ঘটনা বলি। মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের সঙ্গে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি হৃদয়বিদারক। একজন শিক্ষক যদি ক্লাসে মুক্তভাবে কথা বলতে না পারেন, তার চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে?

দেখেন, ২২ বছর ধরে হৃদয় মণ্ডল গণিত ও বিজ্ঞানের ক্লাস নিচ্ছেন অসাধারণভাবে। যে অডিও এবং ভিডিওটি ইচ্ছে করে ছড়ানো হয়েছে যে ঘটনাটি মনে হচ্ছে তাকে ফাঁসাতে সাজানো হয়েছে সেই ঘটনাতেও হৃদয় মণ্ডল যে উত্তর দিয়েছেন সেটাই একজন বিজ্ঞান শিক্ষকের কাজ। একজন সত্যিকারের শিক্ষকের কাজ। একজন শিক্ষক হিসেবে তাকে আমাদের সম্মান করা উচিত যে এই দেশে এখনো এমন অসাধারণ শিক্ষক আছেন।

ভীষণ আফসোস এমন একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘটনা সাজানো হযেছে যেভাবে তাকে জেলে নেওয়া হয়েছে সেটা ভিন্ন এক বাংলাদেশেরই বার্তা দেয়। আফসোস আদালতও তাকে জামিন না দিয়ে জেলে পাঠিয়েছে। আমি দ্রুত এই শিক্ষকের জামিন দাবি করছি। মনে রাখবেন যে জাতি তার সত্যিকারের শিক্ষকদের সম্মান করতে পারে না তাদের ভবিষ্যত অন্ধকার।

দ্বিতীয় যে ঘটনায় আমি বেশ অবাক হয়েছি সেটা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে নামাজের জন্য জায়গা বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন  কয়েকজন ছাত্রী। এর চেয়েও বিস্মিত হয়েছি এই দাবির ব্যাপারে প্রাথমিক সম্মতি দিয়েছেন উপাচার্য।

আমার যে বোনেরা টিএসসিতে নামাজের জায়গা চেয়েছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন টিএসসিতে তো সারাবছর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। নাচ গান সিনেমা হয়। সেখানে গিয়েই আপনাদের কেন নামায পড়তে হবে? আচ্ছা সিনেমা হলে গিয়ে আপনি কী নামায পড়ার জায়গা খুঁজবেন নাকি নামাজের সময় সিনেমা হলে না যাওয়া মঙ্গলজনক আমাকে বলেন তো!

একবার ভাবেন তো টিএসসি থেকে দুই মিনিটেরও কম দূরত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নারীদের জন্য যেখানে নামাজের জায়গা থাকার পরেও টিএসসিতে কেন নামাজ পড়তে হবে? দেখেন টিএসসি মিলনায়তনের পাশে ছেলেদের নামাজ পড়ার যে জায়গা আছে আমি সেখানে বহুদিন নামাজ পড়েছি। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি এখানে নামায পড়ে যাওয়া আসার পথে আপনারা বরং টিএসসিতে আসা এমন  কোন পুরুষ ভাইদের সেই চোখে পড়তে পারেন যেই চোখ বোরকা পরা কিংবা শিশু সব নারীকেই বাজে চোখে দেখে।

স্মারকলিপিতে ছাত্রীরা বলেছেন, একাডেমিক ভবনগুলোর কমনরুম বিকেল ৫টার পর বন্ধ থাকে। ফলে ক্যাম্পাসে অবস্থান করা ছাত্রীদের নামাজ আদায় করতে সমস্যায় পড়তে হয়। আমার যতোটুকু ধারণা তাতে জানি, সন্ধ্যার পর যারা ক্যাম্পাসে থাকে তারা হলে থাকে। কাজেই তারা তো হলে নামাজ পড়তে পারেন। আর এরপরেও আপনারা দাবি করতে পারেন ক্যাম্পাসে ছাত্রীদের নামাজের জন্য আলাদা জায়গা করতে। কিন্তু সেটা টিএসসিতে কেন হতে হবে সেটা আমার মাথায় আসে না। আমার মনে হয় জাতীয় পরিচয়পত্রে ছবির বদলে আঙৃলের ছাপ, সবাইকে জোর করে হিজাব পরানোর চেষ্টা, টিএসসিতে কাওয়ালি কিংবা টিএসসিতে ছাত্রীদের নামাজের জায়গা চাওয়া সব একই সূত্রে গাঁথা।

তৃতীয় বিষয়টা হলো টিপ প্রসঙ্গে। আমি কোনভাবেই বুঝি না কেউ টিপ পরলে কেন তাকে কটুক্তি করতে হবে। আর টিপ আর ইব্রাহিম (আ) এর যে ঘটনা বলা হচ্ছে এটা কোরান বা হাদিসের কোথায় আছে বলতে পারেন? আচ্ছা আমাকে একটা কথা বলেন তো হিজাব যদি আপনার চয়েস হয় টিপ কেন কারো চয়েস হবে না?

এই হিজাব ইজ মাই চয়েস নিয়ে আমার খুব অবাক লাগে। কী ভারত কী বাংলাদেশ কী ইউরোপ কী আমেরিকায় সবক্ষেত্রেই একদল লোক বলবে হিজাব ইজ চয়েস। কিন্তু সেই লোকেরাই আবার শাড়ি পরাকে, টিপ পরাকে বা কোন মেয়ে জিন্স পরলে তাকে গালি দেন। কেন রে ভাই হিজাব যদি আপনার চয়েস হয় তাহলে কেউ হিজাব না পরাটাও কী তার চয়েস নয়? যার যে ইচ্ছে পোশাক পরবে এখানে আরেকজনকে অসম্মান করতে হবে কেন? 

আরেকটা কথা। যারা কথায় কথায় বলেন পোশাকের কারণেই ধর্ষন হয় তারা বলেন তো এক বছরের শিশু কেন ধর্ষিত হয়? যে মেয়েরা বোরকা পরেন তাদের জিজ্ঞাসা করেন তো বোরকার পরার কারণে তাদের রাস্তাঘাটে হয়রানি কম হয় কী না? দেখেন আপনি একজন নারী যে পোশাকেই রাস্তায় বের হোক না কেন এই দেশের একদল অমানুষ পুরুষ তাকে নিপীড়ন করার জন্য বসে থাকে। আমাদের সবার এর বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ করা জরুরী।

শেষ করি রোজার শিক্ষা দিয়ে। আমার প্রায়ই মনে হয়, আমরা ধর্ম মেনে চলার চেয়ে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িটা বেশি করি। দেখেন রহমত, বরকত ও মাগফিরাতের মাস রমজানুল মোবারক। যাবতীয় অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকার মাস এই রমজান। ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশটার দিকে তাকান। বলেন তো কারা জিনিষপত্রের দাম বাড়ালো? বলেন তো কারা ঘুষ খাচ্ছে? বলেন তো কারা দুর্নীতি করছে?

দেখেন রোজার একটা বড় উদ্দেশ্য নিজের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ প্রভৃতি রিপু দমন করা। পার্থিব লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা, পরনিন্দা, মিথ্যাচার, প্রতারণা, অতিরিক্ত সম্পদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি থেকে দূরে থাকার শিক্ষা দেয় রমজান। এবার চারপাশে তাকিয়ে দেখেন তো? একবার নিজের দিকেও তাকান। সারাদিন না হয় না খেয়ে ছিলেন কিন্তু লোভ, ক্রোধ, মোহ, দুর্নীতি, সম্পদের লোভ থেকে দূরে আছি কী আমরা?

দেখেন সিয়াম সাধনার দ্বারা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক স্নেহ, ভালোবাসা, মায়া-মমতা, আন্তরিকতা, দানশীলতা, বদান্যতা, উদারতা, ক্ষমা, পরোপকারিতা, সহানুভূতি, সমবেদনা প্রভৃতি সদাচরণ জন্মানোর কথা। আমাদের কী সেটা হচ্ছে? হলে আজকের বাংলাদেশের এই অবস্থা কেন? কেন আমরা সব ধর্মের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা করতে পারি না?

ইসলামের যে শিক্ষাগুলো আমার সবচেয়ে ভালো লাগে তার একটা হলৈা মানবিকতা আরেকটা হলো নফসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসলামে বারবার নিজের নফসের (প্রবৃত্তির) সঙ্গে জিহাদ করার কথা বলা হয়েছে। স্বীয় নফসের (প্রবৃত্তির) সঙ্গে যে জিহাদ তাকে মহানবী (সা.) সবচেয়ে বড় জিহাদ বলে অভিহিত করেছেন। মহানবী (সা.) বলেছেন, প্রকৃত মুজাহিদ সে ব্যক্তি, যে আল্লাহর আনুগত্য করার ব্যাপারে নিজের নফসের সঙ্গে জিহাদ করে।’

এবার নিজেকে প্রশ্ন করেন। জিনিসপত্রের দাম দ্বিগুণ, ত্রিগুণ বাড়িয়ে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার প্রতিযোগিতায় থেকে, ঘুষ দুর্নীতিতে সবচেয়ে শীর্ষে থেকে, পর্ণে আসক্তে থেকে, নারী নিপীড়ন করে, নারীদের অশ্রদ্ধা করে, সারাক্ষণ গীবত করে, মানুষের জমি দখল করে এই আমরা যখন কথায় কথায় ইসলামের কথা বলি আমার ভীষণ কষ্ট লাগে।

দেখেন যদি আসলেই আমরা নিজেকে সত্যিকারের মুসলমান ভাবি আমাদের তাহলে উচিত মানবিক হওয়া। সব ধর্মের সব বর্ণের সব মানুষকে ভালোবাসা।

দেখেন মানবতার সবক শেখাতে গিয়ে রাসূল (সা.) বলেছেন, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে জিজ্ঞেস করবেন, আমি ক্ষুধার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে আহার্য  দাওনি। আমি তৃষ্ণার্ত ছিলাম, তুমি আমাকে পানি দাওনি। আমি অসুখে ভুগছিলাম, তুমি আমার সেবা করনি। (কেন?)

বান্দা তখন অবাক হয়ে বলবে, হে আমার প্রতিপালক, তুমি যে অভাবমুক্ত, তুমি তো খাও না, পান কর না, তুমি কীভাবে ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত ও অসুস্থ হতে পার? আল্লাহ তায়ালা তখন প্রতিউত্তরে বলবেন, আমার অমুক বান্দা যে ক্ষুধার্ত হয়ে তোমার দুয়ারে হাজির হয়েছিল, তুমি তো তাকে খাবার দাওনি, তাকে দিলে আমাকে দেয়া হতো। পিপাসার্তকে তুমি পানি পান করাওনি, তাকে পানি দিলে আমাকে দেয়া হতো। রোগশোকে ভোগা ব্যক্তি কষ্টে ছটফট করেত, তার সেবা করলে আমাকে সেবা করা হতো, তুমি কী এটা জানতে না? (মুসলিম)

একবার ভাবেন কথাগুলো। মানুষকে সেবা করা মানে সৃষ্টিকর্তাকে সেবা করা। মানুষের পাশে দাঁড়ানো মানে সৃষ্টিকর্তার পাশে দাঁড়ানো। কাজেই মানুষ হওয়াটা খুব জরুরী। এ কারণেই সব ধর্মের মূল কথা মানুষ। কাজেই চলুন আমরা মানুষ হই। সত্যিকারের মানুষ যে মানুষের কাছে সব মানুষ নিরাপদ, যে সব মানুষকে ভালোবাসে। দেখেন এই দেশে সংকটের শেষ নেই। চলুন হিংসা বিদ্বেষ ভুলে সবাই মিলে আমরা এই দেশটাকে সুন্দর করি। সবার আগে বাংলাদেশ। এরপর সবাই মিলে একটা সুন্দর মানবিক পৃথিবী গড়ি। ভালো থাকবেন সবাই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.