সাভারে ভবনধস: যন্ত্রপাতি নেই আছে কেবল মনের জোর

Spread the love

মানুষের জন্যই মানুষ

শরিফুল হাসান

বুধবার রাত তিনটা। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে কান পেতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী আবু ইউসুফ শুনতে পান বাঁচার জন্য মানুষের আকুতি। দেরি না করে বিমটি ভাঙা শুরু করেন তিনি। এরপর দেখেন, ভেতরে বেশ কয়েকটি লাশ। আর সেই লাশের ওপর জীবিত কয়েকজন মানুষ। তাঁরা গোঙাচ্ছেন, কেউ ‘পানি, পানি’ বলে চিত্কার করছেন। রানা প্লাজার সামনে দাঁড়িয়ে গতকাল শুক্রবার আবু ইউসুফ বললেন, ‘বিম ভেঙে ইট-পাথর সরালেও রড থাকার কারণে কাউকে বের করতে পারছিলাম না। রড কাটলে বিমটি ভেঙে পড়তে পারে। সবাই তখন মারা যেতে পারি। কিন্তু মানুষের আকুতিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই কয়েকটি রড কেটে ছোট জায়গা তৈরি করলাম। এরপর একে একে ১৫ জনকে জীবিত আর কয়েকটি লাশ বের করে আনি।’টঙ্গী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান প্রথম বর্ষের ছাত্র মিজানুর রহমান বছর খানেক আগে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে উদ্ধারকাজের প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। সাভারের দুর্ঘটনার খবর শুনেই তিনি এখানে ছুটে এসেছেন। গত তিন দিনে তিনি অন্যদের সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ থেকে অন্তত ২০ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন। আর লাশ উদ্ধার করেছেন শতাধিক। মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন দিন ধরে আমি এখানে আছি। আমার খুব কাছেই একজন মানুষ বাঁচতে চাচ্ছে। কাকুতি-মিনতি করছে, তাকে যেন বাঁচাই। কিন্তু আমি কিছুই করতে পারছি না। কারণ তার পায়ের ওপরে বিম পড়ে আছে। সেই মুহূর্তে নিজেকে মনে হচ্ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ। আর যখন কাউকে বাঁচাতে পারছিলাম, তখন আনন্দে কান্না পাচ্ছিল।’গাজীপুর থেকে উদ্ধারকাজে ছুটে এসেছেন উজ্জ্বল নামের একজন। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। ধ্বংসস্তূপের যেখানেই একটু ফাঁক দেখছেন, সেদিক দিয়ে ঢুকে আটকে পড়া লোকজনকে উদ্ধার করছেন তিনি। এভাবে কাজ করতে গিয়ে নিজে আহত হয়েছেন, তাঁর পা কেটে গেছে। কিন্তু ক্লান্তি নেই উজ্জ্বলের। তিনি বলছিলেন, ‘মানুষের জন্যই মানুষ। এক দিন কাজ না করলে আমার সংসার চলে না। তার পরও আমি এখানে এসেছি। মানুষের জন্য কাজ করে শান্তি লাগছে।’আবু ইউসুফের মতোই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে একের পর এক জীবিত মানুষকে উদ্ধার করে আনছেন ফায়ার সার্ভিসের ২০০ কর্মী। তাঁদের সঙ্গে আছেন মিজানুরের মতো প্রশিক্ষিত ২৭৫ জন স্বেচ্ছাসেবী। আর বাকিরা উজ্জ্বলের মতো সাধারণ মানুষ। তাঁদের কাছে আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই, কিন্তু কেবল মনের তীব্র ইচ্ছায় তাঁরা উদ্ধারকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।গত বুধবার সকাল নয়টার দিকে রানা প্লাজা ধসে পড়ে। তখন থেকেই সাধারণ মানুষ উদ্ধার তত্পরতা শুরু করে। এরপর ফায়ার সার্ভিস, সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব-পুলিশসহ অন্যান্য সংস্থার লোকজন উদ্ধারকাজে অংশ নিতে সাভারে আসেন। তবে অনেকেরই অভিযোগ, উদ্ধারকাজে কোনো সমন্বয় নেই। ঘটনাস্থলে উপস্থিত একজন সরকারি কর্মকর্তা বলেছেন, যেকোনো দুর্যোগ হলেই আইন অনুযায়ী জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে সমন্বয় কমিটি হবে। এরপর সবাই মিলে কাজ করবেন। কিন্তু সাভারে কীভাবে কী হচ্ছে, সেটা অনেকেই জানেন না। স্বজনদের খোঁজে ঘটনাস্থলে উপস্থিত আবুল কাশেম, সামাদ আলী, রবিউল ইসলামসহ অনেকেরই অভিযোগ, সাধারণ মানুষ আর ফায়ার সার্ভিস ছাড়া বাকি সবাই কেবল দেখছে। এ ছাড়া উদ্ধারকাজের দীর্ঘসূত্রিতা নিয়েও ক্ষুব্ধ অনেক মানুষ।ঘটনাস্থলে উপস্থিত অনেকের অভিযোগ, সাধারণ মানুষই ভবনের বিভিন্ন তলায় গিয়ে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছেন। উদ্ধারকাজে ভারী যন্ত্রের ব্যবহার নেই বললেই চলে। পেশাদার বাহিনীর সদস্যরা যদি সক্রিয়ভাবে অংশ নিতেন, ভেতরে যেতেন, তাহলে আরও অনেক মানুষ বাঁচতে পারত।তবে উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, নয়তলা ওই ভবনটি ধসে এখন তিনতলার উচ্চতা নিয়ে আছে। একটি তলার সঙ্গে একটি তলা মিশে গেছে। ফলে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ছোট ছোট সুড়ঙ্গ করে তাঁরা জীবিতদের বের করে আনার চেষ্টা করছেন। কাজটি অনেক কঠিন।উদ্ধারকাজে বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সম্পর্কে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক জিহাদ উল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একটি উদ্ধারকাজে একেকজনের একেক রকম দায়িত্ব থাকে। সবাই মিলেই কাজটি করতে হয়।’ তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে ভবনের ভেতরে প্রতিটি ফ্লোরে ঢুকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা জীবিত ও লাশ বের করে আনছেন। তাঁদের সঙ্গে প্রশিক্ষিত অনেক স্বেচ্ছাসেবী রয়েছেন। বাইরের কিছু সাধারণ মানুষও আমাদের সঙ্গে আছেন। আমরা গর্ত করে করে জীবিত মানুষকে বের করে আনছি। কাজটি অনেক কঠিন। চাইলেও এই মুহূর্তে বুলডোজার দিয়ে ভবনে ঢুকে সবকিছু সরিয়ে নেওয়া যাবে না। কারণ, ভেতরে এখনো অনেক জীবিত মানুষ আছে। সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে।’স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ১৬০ টন হাইড্রোলিক টেলিস্কোপ ক্রেন, ১০০ টন ট্রেলার, ২৫ টন ক্রেন ও আরও কিছু ভারী যন্ত্রপাতি গতকাল বিকেলে সাভারের ধ্বংসস্তূপে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.