শরিফুল হাসান
নীল জলরাশি দিয়ে ঘেরা ছবির মতো দ্বীপ পেনাং। উড়োজাহাজে করে কেউ প্রথম মালয়েশিয়ার এই শহরে এলে বিমোহিত হবেন। তবে জহিরুল, ইব্রাহিম ও নুরুল বাশারের মতো বাংলাদেশি নির্মাণশ্রমিকেরা এই প্রকৃতি উপভোগের অবস্থায় নেই। কারণ, অবৈধভাবে সাগরপথে পেনাংয়ে এসে কাজ পেলেও তাঁরা কাটাচ্ছেন একপ্রকার ‘বন্দিজীবন’।
কেবল পেনাং নয়, মালয়েশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলেই এমন অবস্থায় আছেন অনেক বাংলাদেশি। মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশিদের তথ্য অনুযায়ী, অবৈধভাবে সাগরপথে আসা বাংলাদেশির সংখ্যা এখন এক লাখের বেশি। তবে এমন বাংলাদেশির সংখ্যা সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই বাংলাদেশ হাইকমিশনে। পাসপোর্ট-ভিসা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় এমন বাংলাদেশিরা সব সময় থাকেন পুলিশ-আতঙ্কে। গ্রেপ্তার হবেন—এই ভয়ে তাঁরা কর্মস্থল ছাড়া তেমন বাইরে বের হন না। নিজেদের ‘বন্দী’ রাখেন। সাগরপথে আসা সব বাংলাদেশিরই এক দশা।
পেনাংপ্রবাসী বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি বললেন, অবৈধভাবে সাগরপথে যাঁরা মালয়েশিয়ায় আসেন, তাঁরা প্রথমেই থাইল্যান্ড সীমান্তবর্তী পেনাং রাজ্যে আসেন। পরে এখান থেকে ছড়িয়ে পড়েন ক্লাং, কুয়ালালামপুর, জহুরবারুসহ বিভিন্ন এলাকায়। এখন যেখানেই নির্মাণকাজ, সেখানেই বাংলাদেশি শ্রমিক। এঁদের একটি বড় অংশই সাগরপথে আসা। তবে কাজ পেলেও তাঁদের অবৈধ হয়েই থাকতে হয়।
এমন বাংলাদেশিদের বেশির ভাগই তাঁদের নাম প্রকাশ করতে চান না। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই বললেন, টেকনাফ থেকে ট্রলারে ওঠার আগেও তাঁদের বিশ্বাস ছিল, কোনোমতে মালয়েশিয়ায় আসতে পারলেই ভাগ্য বদলে যাবে। কিন্তু সাগরপথে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়, দালালদের নির্যাতন দেখে সেই স্বপ্ন ক্রমেই ফিকে হয়েছে। ভাগ্য সহায় বলে তাঁরা মালয়েশিয়ায় পৌঁছেছেন এবং কাজও পেয়েছেন। কিন্তু সাগরপথের মতো আবার ‘বন্দিজীবনের’ চক্রে পড়ে গেছেন। কারণ, অবৈধ হওয়ার কারণে পুলিশ-আতঙ্কে যেখানে কাজ করেন, সেখানেই নিজেদের ‘বন্দী’ রাখেন।
মালয়েশিয়ার ১৩টি অঙ্গরাজ্যের একটি পেনাং। সেখানকার রাজধানী জর্জ টাউনের গামা মার্কেটের কাছে বাংলাদেশি অনেক রেস্টুরেন্ট ও দোকান রয়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই জায়গার নাম দিয়েছেন ‘বাংলাবাজার’। গত রোববার বিকেলে ওই ‘বাংলাবাজারে’ যাওয়ার পথে জহিরুল ইসলাম নামের এক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা। বাড়ি যশোরের ঝিকরগাছায়। পেনাংয়ে নির্মাণশ্রমিকের কাজ করেন।
কীভাবে মালয়েশিয়ায় এলেন, জানতে চাইলে জহিরুল কিছুটা সংকোচ বোধ করলেন। একপর্যায়ে বললেন, দুই বছর আগে এলাকার দালাল সবুরের মাধ্যমে টেকনাফ দিয়ে ট্রলারে এসেছেন। ওই ট্রলারে ২৪৯ জন বাংলাদেশি ছিল। ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা দিয়ে তিনি থাইল্যান্ড দিয়ে মালয়েশিয়ায় আসেন। এখন সমস্যা একটাই, সব সময় পুলিশের ভয়ে থাকতে হয়।
কক্সবাজারের উখিয়ার নুরুল বাশার সাগরপথে এসেছেন বছর খানেক আগে। নানা জায়গা ঘুরে তিনিও নির্মাণশ্রমিকের কাজ করছেন পেনাংয়ে। নির্মাণাধীন একটি ভবনের সামনে তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, অবৈধ হওয়ায় রাস্তাঘাটে চলাফেরারও সাহস পান না। সব সময় গ্রেপ্তারের ভয়ে থাকেন। পেনাংয়ে কয়েক দিন আগে পুলিশ কয়েক শ বাংলাদেশিকে গ্রেপ্তার করার পর আতঙ্ক আরও বেড়েছে।
‘বাংলাবাজারে’ আলাপকালে সিরাজগঞ্জের বেলকুচির সিরাজুল ইসলাম বলেন, তিনি আট বছর ধরে মালয়েশিয়ায় আছেন। তিনি মোটামুটি ছিলেন। কিন্তু কয়েক মাস আগে ছোট ভাই ইব্রাহিম আসার পর সব সময় ভয়ে থাকেন। কিসের ভয়—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইব্রাহিম ট্রলারে করে এসেছে। একদিন দালালদের ফোন পেয়ে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা দিয়ে ভাইকে ছাড়িয়ে এনেছেন। ইব্রাহিম নির্মাণশ্রমিক। প্রায়ই পুলিশ অভিযান চালায় বলে আতঙ্কে থাকেন।
সিরাজগঞ্জের লিটন আহমেদ ১৮ বছর ধরে পেনাংয়ে আছেন। তিনি বলেন, তাঁদের নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে ৮০ জন বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন, তাঁদের অর্ধেকই সাগরপথে এসেছেন। সাগরপথে আসা কয়েকজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে দেশে পাঠিয়েছে। যাঁরা আছেন, তাঁদের এই আতঙ্ক নিয়েই থাকতে হবে।
নওগাঁর সোহেল রানা, বরিশালের মোহাম্মদ তারেক, কক্সবাজারের আবদুর রহমানসহ সাগরপথে আসা অর্ধশত বাংলাদেশির সঙ্গে গত দুই সপ্তাহে দেখা ও কথা হয়। অনেকে নাম প্রকাশ করতে চাননি। তবে সবাই বলেছেন, তাঁরা ভালো নেই।
ক্লাং শহরের বিভিন্ন নির্মাণপ্রতিষ্ঠানে লোক দেন যশোরের মোহাম্মদ হাসান। তিনি বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় অনেক কাজ চলছে। ফলে অনেক লোক লাগে। সাগরপথে আসা অনেক লোকও কাজ চায়। আমি দুইটার মধ্যে মিল করে লোক দেই।’
সাগরপথে মালয়েশিয়ায় কত বাংলাদেশি এসেছেন তার সুনির্দিষ্ট তথ্য দিতে পারেনি সেখানকার বাংলাদেশ হাইকমিশন। তাদের কাছে এ বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। তবে পেনাংয়ে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন পিপলস ভয়েস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইউনুছ আলীসহ বেশ কয়েকজন বাংলাদেশির দাবি, সাগরপথে আসা বাংলাদেশির সংখ্যা এক লাখের বেশি। এর মধ্যে পেনাংয়েই আছে ৫০ হাজারের মতো।
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম বলেন, অবৈধভাবে কেউ এলে তিনি পদে পদে বিপদে পড়বেন। কাজেই মালয়েশিয়ায় যাঁরা কাজ করতে আসেন, তাঁদের অবশ্যই বৈধভাবে আসা উচিত। নয়তো দেশের ক্ষতি, মানুষেরও ক্ষতি।



