শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে অনিয়ম
শরিফুল হাসান

নয়টি পদের বিপরীতে ২৯ শিক্ষক, দুটি পদের বিপরীতে ২৪ কর্মকর্তা এবং সাতটি পদের বিপরীতে ২২ কর্মচারী নিয়োগ করেছে রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। উপাচার্য শাদাত উল্লাহ এবং তাঁকে ঘিরে রাখা একটি চক্র এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে একটি কমিটি গঠন করেছে।
নিয়োগ-বাণিজ্য ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত টাকা তুলে আত্মসাৎ, নিয়ম ভেঙে আত্মীয়স্বজন নিয়োগ এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত গাড়ি ব্যবহারসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অভিযোগ রয়েছে উপাচার্যের বিরুদ্ধে। এসব বিষয়ে কথা বলতে ৮ ডিসেম্বর উপাচার্যের দপ্তরে যান আওয়ামী লীগ-সমর্থক বলে পরিচিত নীল দলের ৩০-৩৫ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক।
শিক্ষকদের নীল দলের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা গিয়েছিলাম একজন শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনা তদন্তের অগ্রগতি জানতে। একপর্যায়ে শিক্ষকেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনিয়ম সম্পর্কে কথা তোলেন। এ সময় উপাচার্য ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, তিনি যা করবেন সেটাই আইন।’
সরকার-সমর্থক একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, চাকরির মেয়াদ শেষে বর্তমান উপাচার্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে আছেন। আর সে কারণেই শেষ মুহূর্তে যা ইচ্ছা তা-ই করছেন।
এ প্রসঙ্গে ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, এমন বয়সে কাউকে উপাচার্য করা হোক, যিনি দায়িত্ব শেষে নিজের বিভাগে ফেরত যাবেন। এতে তাঁর অন্তত জবাবদিহি থাকবে।’
তবে উপাচার্য শাদাত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো ভিত্তিহীন। সবকিছু নিয়ম মেনেই করেছেন বলে তাঁর দাবি।
নিয়োগ-বাণিজ্য: গত ৫ জুন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ মোট ৩০টি পদে নিয়োগের অনুমতি চাওয়া হয়। ইউজিসি এসব পদ অনুমোদন করে। কিন্তু তিন ক্যাটাগরির ১৮টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ৭৫ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়।
প্রয়োজনের চেয়ে এত বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ায় তাঁদের অনেকেরই এখন কাজ, এমনকি বসার জায়গা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন দোকানে আড্ডা দিয়ে সময় কাটান অনেকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন সূত্রে জানা গেছে, কৃষি সম্প্রসারণ ও কৃষি বনায়ন বিভাগে একজন করে দুজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দিলেও নেওয়া হয়েছে আটজন। প্রাণরসায়ন ও কৃষি ব্যবসা বিভাগে দুজনের বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ছয়জন, ফার্মাকোলজি, উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে তিনজনের বদলে ছয়জন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া কৃষি প্রকৌশল, কৌলিতত্ত্ব ও কীটতত্ত্ব বিভাগে বিজ্ঞপ্তি না দিয়েই ছয়জন শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। সার্জারি, ডেইরি ও পোলট্রি বিজ্ঞান বিভাগে একজন করে তিনজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
নিয়োগপ্রাপ্তদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি বনায়ন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে মাত্র দুটি কোর্স পড়ানো হয়। এ জন্য সেখানে নয়জন শিক্ষক আছেন। ওই বিভাগে শিক্ষক নিয়োগের অনুমতি দেয়নি ইউজিসি। তার পরও নতুন চারজন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল হকের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত একজনকে শিক্ষিকা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অথচ তাঁর চেয়েও যোগ্য প্রার্থী ছিলেন আরও অন্তত ১০ জন। একইভাবে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ দাসের ঘনিষ্ঠ একজন শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকলেও কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগে স্নাতক সম্মান পাসের আগেই ফজলুল হককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সনদ দেখিয়ে শিক্ষক হয়েছেন।
সাধারণত যাঁর আত্মীয়স্বজন পরীক্ষায় অংশ নেন, তিনি নিয়োগ বোর্ডে থাকেন না। কিন্তু কীটতত্ত্ব বিভাগে একজন শিক্ষক নিয়োগের বোর্ডে ছিলেন ওই প্রার্থীর আপন চাচা ও উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত মিজানুর রহমান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমাকে বলা হয়নি আত্মীয়স্বজন থাকলে বিশেষজ্ঞ হিসেবে নিয়োগ বোর্ডে থাকা যাবে না। এটা বলা হলে আমি থাকতাম না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৫তম ব্যাচের কৌলিতত্ত্ব বিভাগের ছাত্রী শায়লা আক্তার ঈর্ষণীয় ফলের জন্য প্রধানমন্ত্রী পদক পেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর চেয়ে কম যোগ্য প্রার্থীকে ওই বিভাগে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কৌলিতত্ত্ব, কৃষি সম্প্রসারণ ও কীটতত্ত্বে তিন প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে গিয়ে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষাগত যোগ্যতা জিপিএ-৩ দশমিক ৫ থেকে কমিয়ে ৩ করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ও নিয়োগবঞ্চিত একজন মেধাবী প্রার্থী প্রথম আলোকে বলেন, উপাচার্যের এলাকাপ্রীতি ও দলবাজি এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অর্থ লেনদেনের কারণে মেধাবী ও যোগ্য প্রার্থীরা বাদ পড়েছেন।
বিজ্ঞাপনের অতিরিক্ত পদে নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, বিজ্ঞাপনে লেখাই ছিল, পদের সংখ্যা কম বা বেশি হতে পারে। আর শূন্য পদও ছিল। তা ছাড়া, বাজেটে এসব শিক্ষকের জন্য বরাদ্দ আছে। মেধাবী প্রার্থীদের বাদ পড়া প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অভিযোগ ওঠে।
ছাত্রলীগের ১০ নেতা শাখা কর্মকর্তা: ৮ জুলাই যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল, তাতে দুজন শাখা কর্মকর্তা নিয়োগের কথা। কিন্তু নিয়োগ পান ২৪ জন। এঁদের মধ্যে ১০ জনই ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা। এঁরা হলেন ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহসভাপতি তানবীর এহসান, আবু হাসনাত, আবদুল হান্নান, যুগ্ম সম্পাদক হিমাংশু মণ্ডল, রাজীব চন্দ্র বসাক, মাহবুবুর রহমান, হাফিজুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ দুলাল মিয়া, কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য জান্নাত চৌধুরী ও ইব্রাহীম খলিল খান। নিয়ম মেনেই ছাত্রলীগ নেতাদের নিয়োগ দেওয়ার কথা জানালেন উপাচার্য।
আত্মীয়স্বজন নিয়োগ: উপাচার্য তাঁর শ্যালক চৌধুরী এম সাইফুল ইসলামকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁর সরকারি চাকরির অভিজ্ঞতা ছয় মাস। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা থাকার পর তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় মাস পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক পদে চাকরি করেন। কিন্তু তাঁর চাকরির বয়স ১৫ বছর তিন মাস ২৬ দিন ধরে তাঁকে পেনশন সুবিধাসহ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ বয়স ৪০। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের স্ত্রীর (শ্যালকের স্ত্রী) বয়স ৪০ পার হলেও তাঁকে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। এ ছাড়া উপাচার্য তাঁর আপন ভাতিজিকে শাখা কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এই পদে নিয়োগের জন্য বয়স ৩০ চাওয়া হলেও তাঁর বয়স ৩১। মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেখিয়ে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলেও সনদটি যাচাই করা হয়নি।
কোষাধ্যক্ষের দপ্তরে উপাচার্য তাঁর আরেক আত্মীয়কে এমএলএসএস পদে নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া এমএলএসএস পদে থাকা এক আত্মীয়কে সরাসরি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারের মুয়াজ্জিন হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। শেষ সময়ে উপাচার্য তাঁর ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে।
আত্মীয় নিয়োগের বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, সাইফুল ইসলাম অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ছিলেন। সেখান থেকে তাঁকে এনে এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ছয় মাস চাকরি করা প্রসঙ্গে উপাচার্য বলেন, যত দিন হোক, তিনি তো সেখানে ছিলেন। বাকিদের নিয়োগের বিষয়ে তিনি বলেন, যোগ্যতা আছে বলেই তাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন।
আপ্যায়নে লাখ লাখ টাকা: হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, উপাচার্য এ পর্যন্ত আপ্যায়ন ও আনুষঙ্গিক খাতে ২ কোটি ৮৩ লাখ টাকা তুলেছেন। ২০১৩ সালে ঈদুল আজহার জন্য ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা তোলেন তিনি। এ ছাড়া ২৬ মার্চ শিক্ষকদের খাওয়ানোর জন্য ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, পয়লা বৈশাখের জন্য ১ লাখ ৩৩ হাজার টাকা, চলতি বছরের ঈদুল আজহায় খাওয়ানোর জন্য ১ লাখ ৬১ হাজার টাকা তুলেছেন।
এ বছরের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে তিনি ৩৮ হাজার টাকা মুঠোফোনের বিল তুলেছেন। একই সময়ে শিক্ষকদের কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়ানোর বাবদ তুলেছেন ৪৭ হাজার টাকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১২-১৩ অর্থবছরে উপাচার্য কার্যালয়ের আনুষঙ্গিক খরচের (কন্টিনজেন্সি বাজেট) জন্য বরাদ্দ ছিল আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু তিনি তুলেছেন ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। এভাবে বিভিন্ন খাতে তিনি টাকা তুললেও এর সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, ‘কোনো অনুষ্ঠান হলে উপাচার্যের বাসায় লোকজন তো আসবেই। আমার বাসায় কে খেয়েছে, আর কে খায়নি, সেটা আমি জানি। অন্যরা তা কীভাবে দেখবে।’
গাড়ি নিয়ে অনিয়ম: বর্তমানে উপাচার্য তিনটি গাড়ি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে সাদা পাজেরো (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৩-৫৯৭১) গাড়িটি তিনি, ঢাকা মেট্রো চ-৫৩৭৫১৪ গাড়িটি তাঁর স্ত্রী এবং সাদা আরেকটি গাড়ি তাঁর শ্যালক সাইফুল ইসলাম ব্যবহার করেন। এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ‘উপাচার্য হিসেবে আমি দুটি গাড়ি পাই। আর উপাচার্যের আগের যে গাড়িটি ছিল, সেটি খারাপ হয়ে গেছে। তাই আমি একটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে সেটি ব্যবহার করি।’
জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মাদ মোহাব্বত খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা অনিয়ম নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত সাপেক্ষে প্রতিবেদন দেওয়া হবে।’