শাসক দলের চাপে পাবনা ছাড়তে চান কর্মকর্তারা

Spread the love

শরিফুল হাসান

জেলা প্রশাসনের নিয়োগ পরীক্ষা ভণ্ডুলের ঘটনা নিয়ে পাবনা উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। শাসক দলের একটি অংশের চাপের মুখে পাবনা ছাড়তে চাইছেন জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, চাপের কারণে তাঁদের পাবনায় চাকরি করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল সোমবার পাবনা জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এক বৈঠকে বিভিন্ন দপ্তরের সরকারি কর্মকর্তারা এসব কথা বলেন।ছাত্রলীগ-যুবলীগের একটি অংশও পরীক্ষা ভণ্ডুলকারীদের শাস্তির দাবিতে সন্ধ্যায় শহরে সমাবেশ করে। তবে সংগঠন দুটির আরেক অংশ জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে এবং নিয়োগ পরীক্ষা ভণ্ডুলকারী নেতা-কর্মীদের সমর্থনে পথসভা করে।পাবনার ঘটনা সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে গতকাল স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক বলেন, যারা আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছে, তাদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অপরাধী কখনোই রেহাই পাবে না, সে যুবলীগ, ছাত্রলীগ বা অন্য যেকোনো দলেরই হোক না কেন। তিনি বলেন, দায়িত্বে গাফিলতি ও অবহেলার জন্যই পাবনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) প্রত্যাহার করা হয়েছে।এদিকে পাবনা জেলা প্রশাসনকে চাকরির শৃঙ্খলা পরিপন্থী কোনো কাজে না জড়াতে বলেছেন সংস্থাপনসচিব।গত শুক্রবার জেলা প্রশাসনের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী নিয়োগের পরীক্ষাকেন্দ্রে হামলা ও ভাঙচুর করেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন ওই নিয়োগ পরীক্ষা স্থগিত করে। এ ঘটনায় জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মুস্তাফিজুর রহমান, বর্তমান সভাপতি আহম্মেদ শরীফ ও জেলা যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক জহির হাসান, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রায়হানসহ ২৮ জনের নামোল্লেখসহ শতাধিক নেতা-কর্মীকে আসামি করে দুটি মামলা করে জেলা প্রশাসন। গতকাল পর্যন্ত কেবল রায়হানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক: জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে বিকেল চারটা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত সরকারি কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়। এতে জেলা প্রশাসক এ এফ এম মনজুর কাদির, পুলিশ সুপার জামিল আহমেদ, সিভিল সার্জন এ কে এম আশরাফুজ্জামান, অতিরিক্ত তিনজন জেলা প্রশাসক, জেলার সব উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, বিভিন্ন বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী, সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা, আনসার, সমাজসেবা অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকের শুরুতে নিয়োগ পরীক্ষা ভণ্ডুল ও কর্মকর্তাদের ওপর হামলার নিন্দা এবং ঘটনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানানো হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, সরকারি কর্মকর্তারা বৈঠকে জেলা প্রশাসককে বলেন, শাসক দল থেকে নানাভাবে তাঁদের ওপর চাপ আসছে। অন্যায় তদবির না শুনলেই গালাগাল-হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এভাবে চাকরি করা যায় না। কাজেই প্রয়োজনে সবাই একযোগে পাবনা ছেড়ে চলে যাবেন।বৈঠকে উপস্থিত একজন কর্মকর্তা জানান, বৈঠকের একপর্যায়ে বিসিএস ক্যাডারের ২৬ জন কর্মকর্তা জেলা প্রশাসকের কাছে গণবদলির আবেদন করেন। এ সময় জেলা প্রশাসক তাঁদের বলেন, ‘আমরা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সব জানানো হয়েছে। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। যা করার তাঁরাই করবেন।’ এ পর্যায়ে কর্মকর্তারা শান্ত হন। তাঁরা জীবনের নিরাপত্তা এবং মানসম্মান নিশ্চিত করার দাবি জানালে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসক।বৈঠকে পুলিশ সুপার বলেন, ‘অবৈধ তদবির শুনিনি বলে আমাকে গালাগাল শুনতে হয়েছে। এভাবে চলতে পারে না। সেদিন যারা হামলা চালিয়েছে, তারা সবাই সন্ত্রাসী। তারা যতই শক্তিশালী হোক অবিলম্বে তাদের গ্রেপ্তার করা হবে।’সিভিল সার্জন বলেন, ‘স্বাস্থ্য বিভাগের একটি নিয়োগ পরীক্ষায় সরকারি দলের একজন আমাকে ফোন দিয়ে বলেন, তাঁর প্রার্থী এখনো আসেননি। কাজেই পরীক্ষা শুরু করা যাবে না।’জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ইকরামুল হক বলেন, ‘অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ ও পদায়নের জন্য আমার কাছে চাপ আসছে। না শুনলেই গালাগাল শুনতে হয়।’অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিজয় ভূষণ পাল বলেন, ‘আইনের পথেই আমরা চলব। কারও অবৈধ চাপ বা তদবির আমরা শুনব না।’এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, তারা সব কাজই জোর করে নিতে চায়।বৈঠকে পরীক্ষা ভণ্ডুল করার মামলার আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিসহ পাঁচটি সিদ্ধান্ত হয়। এগুলোর মধ্যে আছে, কোনো কর্মকর্তা বিপদে পড়লে তৎক্ষণাৎ সভা করে সব কর্মকর্তা তাঁর পাশে দাঁড়াবেন এবং সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে। কাউকে হয়রানিমূলক বদলি যাতে না করা হয়, সে জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। কর্মকর্তাদের একটি প্রতিনিধিদল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করবেন এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে জানাবেন। বৈঠকে সব কর্মকর্তা বলেন, এভাবে চাপ চলতে থাকলে তাঁরা সবাই পাবনা ছাড়বেন।জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মনজুর কাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ মুহূর্তে আমার কিছু বলার নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সব জানানো হয়েছে। তাঁরাই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন। ঘটনার জন্য মামলা হয়েছে। আইনগতভাবে যা হওয়ার হবে।’সংস্থাপনসচিবের নির্দেশনা: সংস্থাপনসচিব ইকবাল মাহমুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পাবনা জেলা প্রশাসনকে শৃঙ্খলার পরিপন্থী কোনো কাজে না জড়াতে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে যারা হামলা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তা আইনি পথে চলবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাবনা জেলা প্রশাসন গণবদলি চাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি এবং সরকারের তরফ থেকেও কোনো কর্মচারীকে প্রত্যাহার করা হবে না।জানা যায়, মন্ত্রিপরিষদ সচিব আবদুল আজিজের সঙ্গে বৈঠকের পর ইকবাল মাহমুদ এ সিদ্ধান্ত পাবনা জেলা প্রশাসনকে জানান।এর আগে রোববার পাবনা জেলা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন বৈঠক করে গণবদলির আবেদন জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে সমাবেশ: পরীক্ষাকেন্দ্রে হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে সন্ধ্যায় শহরের ইন্দাড়া মোড়ে সমাবেশ করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের একাংশ। সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন জেলা যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খালেকুজ্জামান। বক্তব্য দেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক রকিব হাসান, সহসভাপতি নাদের হেলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফ, স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক শেখ ইকবাল, পৌর যুবলীগের সভাপতি বিশ্বজিৎ, সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজের বর্তমান ভিপি মোরশেদ আহমেদ, সাবেক ভিপি আবদুল আজিজ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ প্রমুখ।সমাবেশে বক্তারা বলেন, যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তারা কখনোই এই সরকারের ভালো চায় না। সরকারকে কলঙ্কিত করতেই এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে।হামলাকারীদের সমর্থনে পথসভা: জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে ও হামলাকারীদের সমর্থনে শহরের আবদুল হামিদ সড়কে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে পথসভা হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা যুবলীগের সভাপতি শরীফউদ্দিন প্রধান। বক্তব্য দেন জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক আবদুল আহাদ, অর্থ সম্পাদক আবদুল হান্নান, প্রচার সম্পাদক মো. কামিল হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।পথসভায় বক্তারা বলেন, বর্তমান জেলা প্রশাসক তাঁদের কথা শুনছেন না। তাঁরা যেভাবে চান সেভাবে কিছুই হচ্ছে না। তিনি ষড়যন্ত্র করে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন। তাই জেলা প্রশাসক ও তাঁর সহযোগীদের পাবনা ছাড়তে হবে। পথসভা শেষে জেলা প্রশাসকের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়।চারজনকে সাময়িক বহিষ্কার: কেন্দ্রীয় যুবলীগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বলা হয়, পাবনার জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ পরীক্ষা পণ্ড করার অভিযোগে সংগঠনের জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক জহির হাসান, যুগ্ম সম্পাদক এনায়েত হোসেন, সাংস্কৃতিক সম্পাদক রায়হান ও ত্রাণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক ফজলুল হক।

Leave a Reply

Your email address will not be published.