শরিফুল হাসান
তিন বছর বয়সে বাবা হারায় মেয়েটি। পাঁচ বছর বয়সে হারায় মাকে। এতিম সেই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল শিশুকালে। কিন্তু যার সঙ্গে বিয়ে সেই স্বামী সবসময় দেশের জন্য আন্দোলন করেন। প্রায়ই জেলে যান। ফলে এই নারীর জীবনযুদ্ধ চললো আজীবন। তবে ধৈর্য্য ধরে ঠান্ডা মাথায় তিনি সব সামলাতেন। কোনদিন কোন লোভ তাকে পেয়ে বসেনি। এমনকি তার স্বামী যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখনও না। বলছি বেগম ফজিলাতুন্নেছার কথা। মানুষকে আমরা তো এমনিতেই মানুষের মর্যাদা দেই না।
আর তিনি যদি হন নারী তাহলে তো কথাই নেই। আর সে কারণেই বাঙালি নারীর ত্যাগ সংগ্রামের মহাকাব্যগুলো আড়ালে থেকে যায়। একইভাবে বঙ্গবন্ধুকে আমরা কম-বেশি জানলেও বেগম ফজিলাতুন্নেছার সংগ্রামটা আড়ালেই রয়ে গেল।আচ্ছা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কেমন মানুষ ছিলেন? চলুন সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি তাঁর কন্যাদের লেখা থেকে। শেখ রেহানা লিখেছেন, ‘গ্রামে জন্ম হওয়া একজন সাধারণ নারী আমার মা। ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত পড়েছেন মিশনারি স্কুলে। কিন্তু কী যে প্রজ্ঞা, কী যে তাঁর ধৈর্য। আমার মায়ের কাছে আমাদের যে জিনিসটা সবার আগে শেখা উচিত, তা হলো ধৈর্য আর সাহস। সবাইকে এক করে রাখা।
‘শেখ রেহানা আরও লিখেছেন, এতগুলো লোক বাড়িতে খাচ্ছে, দাচ্ছে, আমাদের গ্রামে কোন মেয়ে ম্যাট্রিক পাস করেছে, তাকে এনে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দাও, কাকে বিয়ে দিতে হবে! সব সামলাচ্ছেন। এর মধ্যে আমাদের সকালে কোরআন শরিফ পড়া শেখাতে মৌলভি সাহেব আসছেন, তারপর নাচ শিখছি, সেতার শিখছি, বেহালা শিখছি—সব কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্ত। কিন্তু তাঁর নিজের বয়স কত! আমার তো মনে হয়, আমার মা কি কোনো দিন তাঁর শৈশবে কিংবা কৈশোরে একটা ফিতা বা রঙিন চুড়ি চেয়েছেন কারও কাছে! মা-ই তো সব থেকে বঞ্চিত ছিলেন।
অথচ তিনি হাসিমুখে সব সামলাচ্ছেন।’আসলে বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে প্রতিনিয়ত নেপথ্যে থেকে লড়াই করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। কিন্তু কোনদিন কোন অভিযোগ করেননি। বঙ্গবন্ধু দিনের পর দিন জেলে ছিলেন। এ সময় কাপড় সেলাই করে বাড়ি ভাড়া, সংসার চালানোর সবটাই তিনি করতেন। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধুর পাঁচ সন্তানের তিনি শুধু জননী ছিলেন না, ছিলেন তাদের আশ্রয়। বাঙালি জাতির সুদীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপে সক্রিয় সহযোগিতা করেছেন বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা। স্বামীর আদর্শকে ছায়ার মতো অনুসরণ করেছেন। এই আদর্শ বাস্তবায়নে রেখেছেন অসামান্য অবদান। ফলে আজীবন অনেক কষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তাকে।তারপরও প্রতিটা আন্দোলনের সময় জেলখানায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সব তথ্য জানাতেন। বঙ্গবন্ধুর প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশ নিয়ে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগকে সেসব জানাতেন। কারাগারে বঙ্গবন্ধুর মনোবল দৃঢ় রাখতেন।
বেগম ফজিলাতুন্নেছা আবার নানা সময় বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছেন, ছাড় না দিতে বলেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ কিংবা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সবসময় বলেছেন, দেশের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে। সবসময় বলতেন, দেশের জন্য কাজ করো, আমাদের কথা ভেবো না। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বেগম মুজিবসহ সবাইকে গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হয়। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বা বেগম মুজিবের জীবনটা ছিল সাধারণ মানুষের মতো। ৩২ নম্বরের বাড়ি ছেড়ে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনেও যেতে রাজি হননি বেগম মুজিব।
আফসোস এই বাড়িতেই ১৫ আগস্টের কালো রাতে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকের বুলেটের আঘাতে শহীদ হন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। এই কথা আজ বলাই যায়, নেপথ্যে থেকে বঙ্গবন্ধুকে বঙ্গবন্ধু হতে সাহায্য করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা। আমরা যে বঙ্গবন্ধুর লেখা একটা আত্মজীবনী পেয়েছি সেই লেখার পেছনেও মূল প্রেরণা ও উৎসাহ ছিল বেগম ফজিলাতুন্নেছার।
বঙ্গবন্ধু সেই অবদানের কথা স্মরণ করেছেন আত্মজীবনীর প্রথমেই।বঙ্গবন্ধু তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘রেণু খুব কষ্ট করত, কিন্তু কিছুই বলত না। নিজে কষ্ট করে আমার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করে রাখত, যাতে আমার কষ্ট না হয়।’ আর এক জায়গায় লিখেছেন, ‘সে [রেণু] তো নীরবে সকল কষ্ট সহ্য করে, কিন্তু কিছু বলে না। কিছু বলে না বা বলতে চায় না, সেই জন্য আমার আরও বেশি ব্যথা লাগে।’
এই কথাগুলো আজ সকালে আবার লিখছি কারণ আজ এই মহীয়সী নারীর জন্মদিন। আল্লাহ নিশ্চয়ই তাকে জান্নাতবাসী করবেন। শুভ জন্মদিন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এই আগস্টে আপনাকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। নির্লাভ, সৎ আর ত্যাগের যে জীবন আপনি দেখিয়েছেন সেই জীবন হোক সবার অনুপ্রেরণা।