শরিফুল হাসান
রমা চৌধুরীর কথা মনে আছে আপনাদের? মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী। দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) রমা চৌধুরী। শিক্ষক ও লেখিকা রমা চৌধুরী! বাংলাদেশ সৃষ্টির পেছনে যে ক’জন বীরাঙ্গনার ইতিহাস জড়িয়ে আছেন তাঁদের একজন রমা চৌধুরী। ভীষণ আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন মানুষ। চরম দারিদ্র্যের মধ্যেও লেখালেখি আর বই বিক্রি করে জীবন কাটিয়েছেন। আজ এই মানুষটার চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী।
রমা চৌধুরী ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন রমা চৌধুরী। তিনিই ছিলেন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর। লেখাপড়া শেষ করে ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিন পুত্রসন্তানের জননী ছিলেন তিনি। থাকতেন পৈতৃক ভিটা পোপাদিয়ায়। তাঁর স্বামী যুদ্ধ চলাকালে ভারতে ভারতে যান। ১৩ মে সকালে পাকিস্তানি সেনারা এসে চড়াও হয় তাঁর ঘরে। এ সময় দুগ্ধপোষ্য সন্তান ছিল তাঁর কোলে। এরপরও তাঁকে নির্যাতন করা হয়। সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন।পাকিস্তানি সেনারা গানপাউডার দিয়ে আগুন জ্বেলে পুড়িয়ে দেয় তাঁর ঘরবাড়ি। পুড়িয়ে দেয় তাঁর সব সম্পদ। নিজের নিদারুণ এই কষ্টের কথা তিনি লিখেছেন ‘একাত্তরের জননী’ গ্রন্থে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার চারদিন পর ২০ ডিসেম্বর তাঁর বড় ছেলে সাগর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এর ১ মাস ২৮ দিন পর মারা যায় আরেক ছেলে টগর।১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর আরেক ছেলে মারা গেলে পুত্রশোকে তিনি আর জুতা পায়ে দেননি। খালি পায়ে হেঁটে নিজের লেখা বই বিক্রি করে চলতেন এই নারী। মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার পরেও দারিদ্রের কারণে রাস্তায় বই ফেরি করে জীবন কেটেছে তার।
এতো অসহায়, এতো যন্ত্রণাময় জীবন, তবুও কখনো কারো সাহায্য চাননি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী শাকিল ভাই তখন বেঁচে। রমা চৌধুরীকে নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন হওয়ার পর তিনি ২০১৩ সালের ২৭ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রমা চৌধুরীর দেখা করার ব্যবস্থা করালেন। সেদিনের সেই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমি প্রথম আলোতে একটি নিউজ করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সাথে কারো দেখা হলে অনেক সময় তিনি সাহায্য সহযোগিতা চান। অথচ নিজের এত সংগ্রামের পরেও এতোটুকু সাহায্য চাননি রমা চৌধুরী। তাঁর এ আত্মসম্মানবোধে মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রীও নিজের কথা বলেছেন তাঁকে। আধা ঘণ্টার এই অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় তাঁরা বিনিময় করেছেন পরস্পরের কষ্ট। গণভবন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর সেদিন আমি রমা চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তার দৃঢ়তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল।
সেদিন রমা চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আমি আমার কষ্টের কথা বলেছি।দেশ নিয়ে আমি আমার ভাবনার কথা বলেছি। আমি কোনো সাহায্য চাইনি। আমি যে আমার কথাগুলো বলতে পেরেছি, সে কারণেই আমার অনেক ভালো লাগছে। প্রধানমন্ত্রীও আমাকে তাঁর জীবনের নানা কথা বলেছেন। এই সাক্ষাৎকারই আমার বড় পাওয়া।’ রমা চৌধুরী সেদিন আমাকে আরও বলেছিলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ করে আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। এই দেশটাকে আমাদেরই গড়তে হবে। দেশের মানুষকে আমি বলতে চাই চলুন, বিলাসিতা-উপভোগ এসব বাদ দিয়ে সবাই মিলে আমরা এই দেশ গড়ি।’ কী অসাধারণ কথাগুলো! জানি না বিলাসিতা বা উপভোগ বাদ দিয়ে আমরা সবাই মিলে এই দেশটা গড়তে পারবো কী না! জানি না রমা চৌধুরীদের অবদান আমরা কতোটা মনে রাখতে পারবো! আজ চতুর্থ মত্যুবার্ষিকীতে এই বীরকে স্যালুট। পরপারে ভালো থাকুন মা। বাংলাদেশ মানে যে আপনারাই।