বিদেশে পাঠানোর নামে প্রতারণা বছরে মাত্র দেড় হাজার অভিযোগ

Spread the love

শরিফুল হাসান

বরিশালের এনামুল হক, চুয়াডাঙ্গার মোহাম্মদ সোহাগ, নওগাঁর দেলোয়ার হোসেন, টাঙ্গাইলের মনির হোসেন, মিরপুরের ফারুকসহ ২৪ জন কর্মী আরডেন্ট ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড নামের একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় গিয়ে প্রতারিত হন। তাঁরা দেশে ফিরে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোতে (বিএমইটি) অভিযোগ এবং ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। অভিযোগটি পরে চলে যায় প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। প্রতারিত এই কর্মীরা প্রথম আলোকে বলেন, দেড় বছর ধরে ঘোরাঘুরি করেও তাঁরা ক্ষতিপূরণের টাকা পাননি।দুবাই পাঠানোর নাম করে টাকা আত্মসাত্ করার ঘটনায় শরীয়তপুরের আবুল কাশেম, জুয়েল হোসেন ও ছায়েদুর রহমান নামের তিন ব্যক্তি বিএমইটিতে আল-রিফাত ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে পৃথক অভিযোগ করেছেন। এই তিনজন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কাছ থেকে ছয় লাখ ১০ হাজার টাকা নেওয়ার পর দুই বছর পেরিয়ে গেলেও বিদেশে পাঠানো হয়নি, টাকাও ফেরত দেওয়া হয়নি।এ রকম নানাভাবে প্রতারিত হয়ে প্রতিবছর গড়ে দেড় হাজার ভুক্তভোগী বিএমইটি ও বায়রায় অভিযোগ করেন। কিন্তু এসব অভিযোগের বেশির ভাগই দিনের পর দিন নিষ্পত্তির অপেক্ষায় পড়ে থাকে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এক বছরে বিদেশে যেতে গিয়ে মোট কত লোক প্রতারিত হচ্ছে, সরকারের কাছে সেই হিসাব নেই।বিএমইটি সূত্র জানায়, তাদের অভিযোগ সেলে ২০০৯ সালে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এক হাজার পাঁচটি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে ৮০০ অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় গত বছর নয়টি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হয়। ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় পাঁচ কোটি ছয় লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এই টাকা ৮০০ ভুক্তভোগীকে দেওয়া হয়।একই সময়ে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজে (বায়রা) আরও প্রায় ৪০০ অভিযোগ জমা পড়ে। বায়রার অভিযোগ নিষ্পত্তি (আরবিট্রেশন) কমিটি এর মধ্যে ১০০ অভিযোগ নিষ্পত্তি করেছে। বাকিগুলো নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে। এসব অভিযোগের পর আটটি প্রতিষ্ঠানের বায়রার সদস্যপদ বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করেছে কমিটি। বায়রা সূত্র এ কথা জানায়।বিএমইটির সূত্র জানায়, এর আগে ২০০৮ সালে বিএমইটিতে মোট অভিযোগ জমা পড়ে এক হাজার ১০টি। সেগুলোর মধ্যে ৭৪৫টির নিষ্পত্তি হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আদায় করা হয় মাত্র এক কোটি ৯৭ লাখ ২৫ হাজার টাকা।প্রবাসী শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হেদায়েত উল্লাহ বলেন, কত লোক যে বিদেশে যেতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সেই হিসাব নেই। সরকারি দপ্তরে যত অভিযোগ জমা পড়ে, বাস্তবে এর চেয়ে বহু গুণ বেশি মানুষ প্রতারিত হয়। কিন্তু দরিদ্র বেশির ভাগ মানুষই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে ছোটাছুটি করতে পারে না। তারা ক্ষতিপূরণের জন্য পথে পথে ঘুরে। অনেকেই সারা জীবনের জন্য নিঃস্ব হয়ে যায়।বায়রার মহাসচিব গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, কিছু অসাধু জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের কারণে সবাই দুর্নামের ভাগিদার হচ্ছে। সরকার অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিক। এ ক্ষেত্রে বায়রা কোনো অসাধু প্রতিষ্ঠানের দায় নেবে না। বিএমইটির পরিচালক (এমপ্লয়মেন্ট সার্ভিস) আক্তার-উজ-জামান প্রথম আলোকে জানান, ২০০৯ সালে জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগগুলোর বেশির ভাগই মালয়েশিয়া থেকে ফেরত আসা শ্রমিকেরা করেছেন। তাঁরা চুক্তি অনুযায়ী মালয়েশিয়া থাকতে পারেননি। অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আল জারফ ইন্টারন্যাশনাল, জিয়া ওভারসিজ, সামু ওভারসিজ ও আল-সৌদ ওভারসিজের লাইসেন্স বাতিল এবং মালয়ট্রেড ও ম্যাক্সিম ট্রেডের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়েছে। এ ছাড়া আরও তিনটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।জাতিসংঘের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ঢাকার কর্মকর্তা আসিফ মুনির প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারণা থেকে বাঁচতে সবার আগে বিদেশগামী শ্রমিকদের সচেতন হতে হবে। আইওএম সরকারের সহযোগিতায় এ কাজটি করছে। তবে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর। তিনি বলেন, যারা বিদেশে যেতে চায় তারা বেশির ভাগই দরিদ্র। এই মানুষগুলো যখন প্রতারিত হয়, তখন তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারে না। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য একটি ব্যবস্থা থাকলে ভালো হয়। জানতে চাইলে বিএমইটির মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী বলেন, বিদেশগামী শ্রমিকেরা যেন কোনোভাবেই প্রতারিত না হয়, সে জন্য সব ধরনের চেষ্টা চলছে। স্মার্ট কার্ড পুরোপুরি চালু করা গেলে প্রতারণা অনেক কমে আসবে। আর অভিযোগ প্রমাণিত হলে কোনো অসাধু জনশক্তি রপ্তানি প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দেওয়া হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published.