বড় কর্মকর্তাদের নাম আসছে

Spread the love

শরিফুল হাসান


সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে বাংলাদেশ সরকারি প্রিন্টিং প্রেসের (জিপি প্রেস) সহকারী পরিচালক খন্দকার মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গতকাল রোববার রংপুরের পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এ ঘটনায় পিএসসির প্রশাসনিক কর্মকর্তা এম এ রউফ গ্রেপ্তার হয়েছেন বলে জানা গেছে।পুলিশ জানায়, সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকিরও (পরিচিতি নম্বর ৫৪১) প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে জড়িত। নাম এসেছে বিজি প্রেসের বাইন্ডার সাহে আলমেরও (পরিচিতি নম্বর ৭৭৪)। শহীদুল ও সাহে আলমসহ বিজি প্রেসের ৬১ জন কর্মচারী গতকাল রোববার অফিস করেননি। তাঁরা ছুটিও নেননি। বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ বলছে, হঠাৎ না জানিয়ে ছুটি কাটানোর কারণে এসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি সন্দেহ বেড়েছে। আজকালের মধ্যে অফিসে না এলে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রংপুরের পুলিশ জানিয়েছে, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সঙ্গে বিজি প্রেসের চার কর্মচারীর জড়িত থাকার নিশ্চিত তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। এঁদের মধ্যে এ টি এম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী বিজি প্রেসের বাইন্ডার লাবণী বেগমকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মোস্তফা রংপুরে ও লাবণী শুক্রবার রাতে ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। তাঁদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাইন্ডার সাহে আলম ও শহীদুল ইসলাম ফকিরকেও খুঁজছে পুলিশ। ঘটনার পর থেকেই তাঁরা পলাতক।সরকারি প্রিন্টিং প্রেসের (জিপি প্রেস) উপপরিচালক আবু ইউসুফ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে জানান, খন্দকার মোহাম্মদ আলী বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেসের সহকারী পরিচালক। জিপি প্রেসে সহকারী পরিচালক না থাকায় তিনি অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এখানে ছিলেন। গতকাল তিনি অফিস করেননি। তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে তিনি শুনেছেন।তবে মোহাম্মদ আলীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রংপুরের পুলিশ সুপার সালেহ মোহাম্মদ তানভীর। বাংলাদেশ ব্যাংক তাঁর ব্যাংক হিসাবে লেনদেন স্থগিত করতে সব ব্যাংককে নির্দেশ দিয়েছে।বিজি প্রেসের উপপরিচালক ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির সদস্য মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শহীদুল ও সাহে আলমকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে কাজে যোগ না দিলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া যদি কেউ অনুমতি ছাড়া ছুটি কাটান এবং এর যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা দিতে না পারেন, তাহলে তাঁদের বিরুদ্ধেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মজিবুর রহমান জানান, গতকাল ৬০ থেকে ৭০ জন কর্মচারী অনুপস্থিত ছিলেন। কেন অনুপস্থিত ছিলেন, তা খুঁজে দেখা হবে। এঁদের কেউ আগামী কয়েক দিনও না এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গতকাল এ নির্দেশনা সব শাখায় পাঠানো হয়েছে। প্রতিদিন বেলা ১১টার মধ্যে সব শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতির কাগজপত্র দিতে হবে। আগামী কয়েক দিন নিয়মিত এটি পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া এখন সব ধরনের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, গতকাল বাইন্ডিং শাখার ২৪ জন, কম্পোজিটরদের মধ্যে ৩৫, সুপারভাইজার ২১, মেশিন বিভাগের ১০ এবং চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে ১৪ জন অনুপস্থিত ছিলেন।অনুমোদনহীন ছুটিতে থাকা তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গোপনীয় শাখার বেশ কয়েকজন কর্মচারী ৮ জুলাই থেকে ছুটিতে আছেন। একজন সহকারী ক্যামেরাম্যান ৫ জুলাই থেকে অননুমোদিত ছুটিতে। এ ছাড়া ৭ জুলাই থেকে দুজন কম্পোজিটর ছুটিতে আছেন।জিপি প্রেসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীও গতকাল অফিস করেননি। সেখানকার কয়েকজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে জানান, পাশাপাশি অবস্থিত হওয়ায় বিজি প্রেসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে মিলে জিপি প্রেসের কিছু লোকও প্রশ্নপত্র ফাঁসের কাজ করতে পারেন।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জিপি প্রেসের উপপরিচালক আবু ইউসুফ বলেন, কারা অননুমোদিত ছুটিতে আছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গতকাল দুজন মেশিনম্যান ছুটি ছাড়াই কার্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন।ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছাপার ভিডিও হয়নি: ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র ছাপানোর ঘটনা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় রেকর্ড হয়নি। ৩০ জুন শিক্ষা অধিদপ্তর ওই পরীক্ষার এক লাখেরও বেশি প্রশ্নপত্র ছাপানোর কথা জানায় বিজি প্রেসকে। ৬ জুলাই গোপনীয় শাখায় ছাপার কাজ শেষ হয়।বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষ বলছে, ক্যাসেট না পাওয়ায় এই প্রশ্নপত্র ছাপার কার্যক্রম রেকর্ড করা যায়নি। বিজি প্রেসের উপপরিচালক মজিবুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, যে মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর প্রশ্নপত্র ছাপাতে দেয়, তারাই ক্যাসেট দিয়ে যায়। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরায় ওই ক্যাসেট দিয়েই রেকর্ড করা হয়। কিন্তু শিক্ষা অধিদপ্তর কোনো ক্যাসেট না দেওয়ায় রেকর্ড করা হয়নি। সব প্রশ্নপত্র কেন রেকর্ড করা হয় না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সারা বছরই কোনো না কোনো পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপার কাজ চলে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার ক্যাসেট কিনতে বছরে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা লাগে। বাজেট না পাওয়ায় এত ক্যাসেট কেনা যায় না। কর্মকর্তারা জানান, এর আগে ১৯৯৭ সালে সারা দেশে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। তখন বিজি প্রেসের নয় কর্মচারী জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে বেরিয়ে আসে। কিন্তু তাঁরা এখনো বহাল তবিয়তে চাকরি করছেন। পুলিশের দায়িত্বহীনতা: বিজি প্রেসের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিজি প্রেসের গোপনীয় শাখায় প্রবেশ করা ও বেরিয়ে আসার সময় প্রত্যেককে পুলিশ দিয়ে তল্লাশি করতে হয়। সব মিলিয়ে বিজি প্রেসে ১৪ জন পুলিশ থাকার কথা। কিন্তু বিজি প্রেস কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই সেখান থেকে পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয়। এ ব্যাপারে বিজি প্রেস থেকে কয়েক দফায় চিঠিও দেওয়া হয়ছে।অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (ফোর্স) রিফাত রহমান বলেন, সেখানে নিয়মিত পুলিশ থাকে। কখনোই পুলিশ নিয়ে যাওয়া হয় না। রংপুরে আরও ১১ জন রিমান্ডেনিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় গতকাল আরও ১১ জনের রিমান্ড মঞ্জুর হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গোয়েন্দা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ রানার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাঁদের দুই দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দেন। এ নিয়ে রিমান্ডে নেওয়া আসামির সংখ্যা দাঁড়াল ১৯। রিমান্ডে নেওয়া ১১ জন হলেন কিশোরগঞ্জ মহিলা ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমান, রংপুর সিও বাজারের ব্যবসায়ী আবদুর রাজ্জাক, ঢাকার ফারহানা খানম, কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার গোলাম মোস্তফা, রাজবাড়ীর সুদর্শন কুমার কুন্ডু, ময়মনসিংহের হাসেম মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাইজউদ্দিন, পাবনার মামুনুর রহমান, রংপুরের জালালউদ্দিন, আবদুল আজিজ ও শফিকুজ্জামান।পুলিশ জানায়, আগে রিমান্ডে থাকা আটজনের মধ্যে হামিদুল ইসলাম বলেছেন, বিজি প্রেস থেকেই তাঁরা প্রশ্নপত্র বের করেছেন। এরপর অধ্যক্ষ মাহফুজার রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি রংপুরে জড়ো হওয়ার আয়োজন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.