শরিফুল হাসান
তারিখটা আজও মনে আছে। ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল। সেদিন রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ অফিসার বা নির্বাহী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের লিখিত পরীক্ষা ছিল। তার আগের রাতেই আমার কাছে পরিস্কার তথ্য প্রমাণ চলে আসে যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম মেসেঞ্জারে সেই প্রশ্নপত্র অনেকেই পেয়েছে বলে আমাকে জনিয়েছিলেন। আমার কাছে সেগুলোর স্ক্রিনশট ছিলো।
পরীক্ষা শুরুর আগের দিন রাতেই মেসেঞ্জারে প্রশ্নপত্র পেয়েছেন দাবি করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র আমাকে জানান, বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা তাঁর এক বন্ধু হাতে লেখা একটি ইংরেজির অনুবাদ মেসেঞ্জারে দিয়ে বলে তাঁর কাছে জনতা ব্যাংকের প্রশ্নপত্র আছে। এটি ৬ নম্বর প্রশ্নের উত্তর। এক লাখ টাকা দিলে পুরো প্রশ্নপত্র উত্তরসহ তাকে দেবে। আর অন্য কেউ প্রশ্ন নেবে কী না সেটাও খোঁজ করতে বলে। কিন্তু তাঁর কাছে এত টাকা না থাকায় তিনি গুরুত্ব দেননি। কিন্তু পরদিন পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখেন হুবহু ওই অনুবাদটি এসেছে।
এই ছেলেটির কাছে হাতেলেখা যে অনুবাদটি পাওয়া গিয়েছিল তাতে সময় লেখা বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত অর্থাৎ শুক্রবার রাত ১২ টা ২২। অর্থাৎ পরীক্ষা শুরুর ১৫ ঘণ্টা আগে এই প্রশ্নপত্রটি ছড়িয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে থাকা এক ছাত্রী আমাকে জানান, তাঁকে মেসেঞ্জারে তাঁর এক বন্ধু চারটি অঙ্কের একটি স্ক্রিনশট পাঠায়। পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখেছেন চারটি অঙ্কই এসেছে।
রাজধানীর ইডেন কলেজ, লালমাটিয়া কলেজ ও সেন্ট্রাল রোডের আইডিয়াল কলেজ কেন্দ্রে সেদিন ওই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। পরীক্ষা শেষে অনেক পরীক্ষার্থী সেদিন আমার কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ করেন। এ ছাড়া ইডেন কলেজে পরীক্ষা দেওয়া এক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়; যিনি স্বীকার করেন পরীক্ষা শুরুর ২০ থেকে ২৫ মিনিট আগেই তিনি প্রশ্নপত্র পেয়েছিলেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের এক ছাত্র ওই হলের একটি কক্ষ নম্বর দিয়ে আমাকে অভিযোগ করেছিলেন, এই কক্ষের ছেলেরা নিয়মিত প্রশ্নপত্র ফাঁস করে। তিনি পরীক্ষা শুরুর আগে ওই কক্ষের কয়েকজনের হাতে অঙ্কের উত্তর দেখেছেন। পরে জানতে পারেন সেগুলোই পরীক্ষায় এসেছে।প্রশ্ন ফাঁসের এমন বহু অভিযোগ ছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের একজন কর্মী আমাকে জানিয়েছিলেন, বেলা দুইটার দিকে জসীম উদ্দিন হলের একজন প্রশ্নসহ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তিনি মামলার ভয়ে সেটা ডিলিট করে দিয়েছেন। যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা জানিয়েছেন এই প্রশ্নগুলোই এসেছে।এসব তথ্য প্রমাণ হাতে থাকার পর আমি ওইদিনই নিউজ করি জনতা ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস। নিউজটা প্রথমে অনলাইনে যায়। এরপর থেকেই আমি মূলত ফরিদ স্যারের প্রভাব বুঝতে পারি।
এই পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ এবং সেখানকার ডিন ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। আমার কাছে নানা জায়গা থেকে ফোন আসে নিউজটা না করার জন্য। এমনকি প্রথম আলোকেও আমার বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। নিউজটাও সেই সময় ভালো ট্রিটমেন্ট পায়নি। কোন কোন সহকর্মী চেয়েছিলেন নিউজটা আটকে দিতে। কিন্তু নিউজটা আমি আগেই আমাদের অনলাইনে প্রকাশ করে ফেলি। (https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A7…)ওই সময়টায় একের পর এক প্রশ্ন ফাঁস হতে থাকে তখন চাকুরিপ্রার্থীরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তারা এ নিয়ে বিক্ষোভ করতে থাকে। ছাত্রলীগের রাজনীতিসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন করেন এমন অনেকেই চাকুরিপ্রার্থী ছিলেন যারা আন্দোলনে যোগ দেন। এদের মধ্যে একজন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রকিব হাসান।
ছাত্রলীগের রাজনীতি করা এই ছেলেটার সততা ও সাহস আমাকে মুগ্ধ করে। রকিব ওই সময় আমার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। রকিব প্রশ্নপত্র ফাঁসের সব তথ্য প্রমাণ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কাছে দিয়ে আসে। কিন্তু ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি কোন ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ফরিদ স্যারের কাছে তাদের যেতে বলেন। কিন্তু পরীক্ষার পর গত তিন দিনেও তিনি আমাদের সময় দিচ্ছেন না। রকিব জানায়, নানাভাবে তাদের ভয় দেখানো হচ্ছে।
এমনকি চাকুরি দিয়ে দেওয়ার প্রলোভনও দেখানো হচ্ছে। কিন্তু আন্দোলনকারীরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানায়, তারা পরীক্ষা বাতিল চায়। আমি খুবই বিস্মিত হই প্রশ্নপত্র ফাঁসের এতো প্রমাণ থাকার পরেও কেন পরীক্ষা বাতিল হবে না? সেদিন ফরিদ স্যার কী বলেছিলো আপনারা শুনে বিস্মিত হবেন। প্রথম আলোয় সেই বক্তব্য ছাপা হয়েছিল। এখনো যে কেউ অনলাইনে সেটা পাবেন। ফরিদ স্যার সেদিন বলেছিলেন, ‘পরীক্ষার আগে আমাদের কাছে কেউ জানায়নি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এসএসসি এইচএসসি অনেক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে ভাইরাল হয়ে যায় কিন্তু পরীক্ষা তো বাতিল হয় না। পরীক্ষার আগে কেউ যেহেতু জানায়নি কাজেই এখন আমরা বিষয়টা আমলে নেব না। আর তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে অনেক কিছু বানানো যায়।’( বিস্তারিত পাবেন এখানে https://www.prothomalo.com/…/%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A7…)
এবার বলেন যে শিক্ষক মনে করে এসএসসি এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও যেহেতু পরীক্ষা তো বাতিল হয় না এখনো বাতিল হবে না। অবশ্য বিষয়টি শেষ অব্দি আদালতে গড়ায়। আন্দোলনকারীরা সব প্রমাণ নিয়ে হাইকোর্টে যান। আদালতে শিক্ষার্থীদের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, অ্যাডভোকেট সুপ্রকাশ দত্ত ও রিপন বড়ুয়া।
সব প্রমাণ দেখে হাইকোর্টের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরী ও বিচারপতি মোহাম্মদ ইকবাল কবীরের সমন্বয়ে বেঞ্চ ২০১৮ সালের ১৬ আগস্ট এই পরীক্ষা বাতিল করে পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশ দেন। জয় হয় শিক্ষার্থীদের।
আমার বেশ মনে আছে, প্রশ্নপপত্র ফাঁস নিয়ে সিআইডি অনেক কাজ করছে এবং সিআইডি জানিয়েছিল, রাজধানীর ইন্দিরা রোডের ‘পিপলস প্রিন্টিং প্রেস’ নামের একটি ছাপাখানা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ ইউনিটের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছিল। শুনেছিলাম এই ছাপাখানা থেকে প্রশ্নপত্র ছাপানোর সিদ্ধান্তটা ডীন স্যারের ছিল।
যাই হোক আমার আমার ভীষণ আফসোস লাগে ২০১৭ সালে জনতা ব্যাংকের প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ব্যর্থতায় যে লোকটার শাস্তি হওয়ার কথা, অন্তত দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্টো এই সরকার তাকে পুরুষ্কৃত করলো যিনি কী না আবার শুনি জিয়া চেয়ারের প্রস্তাবক।
বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাত্র চারমাস পর ২০১৭ সালের ১৭ অগাস্ট সরকার ফরিদ স্যারকে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয়। ২০২১ সালে তার প্রথম মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার প্রায় দেড়মাস আগে তাকে দ্বিতীয় মেয়াদে উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়।
উপাচার্য হিসেবে ফরিদ স্যার কেমন সেই বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। স্যারকে আমার দারুণ লাগে! ভীষণ প্রভাবশালী মানুষ মনে হয়! স্যার আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। কোন ডক্টরেট ডিগ্রি না নিয়েও স্যার ডীন ছিলেন, ভিসি হয়েছেন। শিক্ষকদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয় তাই তিনি শিক্ষক সমিতির নেতা ছিলেন। এখন সব শিক্ষকরা তার সাথে।
শুনলাম অরো ৩৪ উপাচার্য স্যারের পক্ষে আছেন। দারুণ ব্যাপার!তিনি হয়তো আসলেই বিশ্ববিদ্যালয়টা দারুণ চালাচ্ছেন! তবে যে উপাচার্য ক্ষমতায় থাকার জন্য পুলিশ দিয়ে ছাত্র পেটাতে পারেন, যিনি শিক্ষক হয়েও একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে নোংরা মন্তব্য করতে পারেন তাঁর বিষয়ে সরকারের কেন এতো আন্তরিকতা সেটা একটা বিস্ময়! আবার ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য সব শিক্ষক ও উপাচার্যরা কেন তার পক্ষে সেটাও একটা ম্যাজিক!
আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই সাংবাদিকতা করতাম বলে শিক্ষক রাজনীতি থেকে শুরু করে বহু কিছু খুব কাছ থেকে দেখেছি। মূলত এ কারণেই আমার আর কখনো আর পেশা হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে ইচ্ছে করেনি, যদিও পড়াতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। জানি না এই দেশে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে নানাক্ষেত্রে যতো সমস্যা আর অনিয়ম তাতে আমাদের উপাচার্য ও শিক্ষকরা বোধহয় ফরিদ স্যারকেই তাদের যোগ্য প্রতিনিধি মনে করেন। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। আমার শুধু একটাই কথা।
আপনারা মনে রাখবেন, কোন ভিসি, শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী কারো জন্য নয়, একটা বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে মূলত শিক্ষার্থীদের জন্য। শিক্ষার্থীরাই ক্যাম্পাসের প্রাণ। কাজেই শিক্ষার্থীরা সামস্টিকভাবে যখন কারো বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তখন সেই লোকের ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে থাকতে চাওয়া অনৈতিক। আবার তাকে ধরে রাখতে সরকার বা যে কারো চেষ্টাও খুব দৃষ্টিকটু লাগে। অবশ্য এই অনৈতিক চর্চাই এই রাষ্ট্রে চলছে দিনের পর দিন!
শেষ করি আরেকটা কথা দিয়ে। আমি ব্যক্তিগতভাবে শিক্ষকদের খুব সম্মান করি। আপনারা শিক্ষক আর উপাচার্যরা একটু দয়া করে ভাববেন কী, একটা ছেলেমেয়ে ৪-৫ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ে কাটায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের দোকানদার থেকে শুরু করে হলের মামা, দাদু সবাইকে তারা ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে, স্মরণে রাখে, সেখানে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে আমাদের শিক্ষকরা নেই কেন? আচ্ছা সম্মান কী এমনি এমনি আসে? আপনারা শিক্ষকরা একটু ভাবুন। একটু চিন্তা করুন।
সমস্যাটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করুন। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেহেতু এতো কথা জাফর ইকবাল স্যাররে কথাতেই শেষ করি। স্যার বলেছেন, আমার প্রিয় শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় ভালো নেই। আমি তাতে যুক্ত করে বলি, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আসলে ভালো নেই। সহজ করে বললে, আমরা আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধ্বংসের সব আয়োজন করেছি। আমি জানি না এই ধ্বংস ঠেকানোর উপায় কী? আমাদের শিক্ষক মহোদয়রা গবেষণা করে সমস্যার সমাধান করতে পারেন!