প্রশ্নপত্র ফাঁস

Spread the love

সেই শহীদুল বিজি প্রেসে এসে অবরুদ্ধ, উদ্ধার করল পুলিশ

শরিফুল হাসান


সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেসের কম্পোজিটর শহীদুল ইসলাম ফকিরকে গ্রেপ্তার করা গেলেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের পুরো চক্রের সন্ধান মিলবে। বেরিয়ে আসবে সব তথ্য। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ কথাই বারবার বলেছেন। কিন্তু ঘটনার নয় মাস পরও শহীদুলকে খুঁজে পায়নি পুলিশ।অথচ সেই শহীদুল গতকাল মঙ্গলবার বিজি প্রেসে বকেয়া নয় মাসের বেতন তুলতে গিয়ে অবরুদ্ধ হয়েছেন সহকর্মীদের হাতে। একই সঙ্গে অবরুদ্ধ হয়েছেন আরও দুই অভিযুক্ত বিজি প্রেসের কম্পোজিটর এ টি এম মোস্তফা ও তাঁর স্ত্রী বিজি প্রেসের বাইন্ডার লাবণী বেগম। বিজি প্রেসের ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা তাঁদের আটকে রাখলেও পরে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় নিয়ে যায়।কর্মচারীরা জানান, এই তিনজনের সঙ্গে আরেক অভিযুক্ত বিজি প্রেসের অফসেট শাখার ফর্মা প্রুফ প্রেসম্যান আবদুল জলিলও এসেছিলেন। ফটকে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে কর্মচারীরা চিনে ফেলার পর বাধা দেওয়ায় তিনি দৌড়ে বেরিয়ে যান।প্রসঙ্গত, প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার পর বিজি প্রেসে জলিলের একটি ট্রাঙ্ক থেকে ২৮ লাখ টাকা উদ্ধার এবং তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। এ ছাড়া এ টি এম মোস্তফার ভায়রা শফিউর রহমানের ব্যাংক হিসাব থেকে এক কোটি ৪৩ লাখ ৫০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।বিজি প্রেসের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে জানান, গতকাল বেলা ১১টার দিকে শহীদুল, মোস্তফা ও লাবণী বকেয়া বেতন তুলতে বিজি প্রেসে আসেন। গেটে নিরাপত্তাকর্মীরা পরিচয় জানতে চাইলেও তাঁরা পরিচয় না দিয়ে ক্যাশ শাখায় যান। তাঁরা ক্যাশ শাখায় বেতন চাইলে সেখানকার কর্মচারী তা দিতে আপত্তি করেন। খবর পেয়ে আরও কর্মচারীরা সেখানে জড়ো হন এবং এই তিনজনকে চিনতে পেরে অবরুদ্ধ করেন। এ সময় কর্মচারীরা তাঁদের পিটুনি দেওয়ারও চেষ্টা করেন।প্রত্যক্ষদর্শী একজন কম্পোজিটর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা অনেক কর্মচারী ওই তিনজনকে ঘিরে রাখি। আমরা তাদের বলি, তোমাদের কারণে বিজি প্রেসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কোথাও পরিচয় দিতে পারে না। আবার তোমরা এসেছ কেন? এ সময় ক্ষুব্ধ কর্মচারীরা তাদের দিকে তেড়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ওই তিনজনকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।’বিজি প্রেসের উপপরিচালক মো. জাকির হোসেন বলেন, ‘ওই তিনজনই সাময়িকভাবে বরখাস্ত আছেন বলে অর্ধেক বেতন পান। সেই টাকা তুলতে এসে তাঁরা সবার রোষানলে পড়েন।’শহীদুল যা বললেন: দুপুর পৌনে দুইটার দিকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার হাজতখানায় আটক শহীদুল ইসলাম ফকিরের কাছে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’ কিন্তু যে পোশাকের পকেটে করে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তা তো আপনার বাসায়ই পাওয়া গেছে—এর জবাবে তিনি বলেন, ‘পুলিশ যে আমার বাসা থেকেই ওই পোশাক উদ্ধার করেছে, তার প্রমাণ কী?’শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিজি প্রেসের গঠিত পৃথক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে শহীদুলের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ আনা হয়েছে। এর প্রতিবাদ করেছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজন মনে করিনি।’ এত দিন কোথায় ছিলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর ঢাকায় আসি। আদালতে গিয়ে জামিন নিয়েছি।’বিজি প্রেসের সহকারী পরিচালক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে জানান, প্রশ্নপত্র ফাঁসের পর থেকে শহীদুল অফিসে আসেননি। ১১ জুলাই তাঁর ঠিকানায় চিঠি দিয়ে তাঁকে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যে কাজে যোগ দিতে বলা হয়। কিন্তু তিনি কাজে যোগ দেননি। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এরপর তাঁর কোনো খোঁজখবর পাওয়া যায়নি। তাঁর তেজগাঁওয়ের বাসায়ও কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁকে স্থায়ীভাবে বরখাস্তের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে।প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে এ টি এম মোস্তফা কথা বলতে রাজি হননি। নিশ্চুপ ছিলেন তাঁর স্ত্রী লাবণী বেগমও।তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিজি প্রেসে ওই তিনজন কর্মচারীদের রোষানলে পড়লে পুলিশ গিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে। যেহেতু তাঁরা জামিনে আছেন, তাই রাতে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়।’ তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা যোগাযোগ করেছিলেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, কেউ যোগাযোগ করেনি। আইন অনুযায়ী তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।ধরাছোঁয়ার বাইরে: প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে সে সময় নাম এসেছিল নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের আতিকুল ইসলাম, যিনি ঘটনাস্থল রংপুরের ভিন্নজগতের মিলনায়তন বুকিং দিয়েছিলেন, ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা মোটরসাইকেলের স্বত্বাধিকারী রংপুর জেলা পরিষদের অফিস সহকারী আলাউদ্দিন, আমজাদ হোসেন এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সুলতান আহমেদের। কিন্তু তাঁরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছেন। শহীদুলের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ উঠলেও তাঁকেও গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি।পুলিশ বলছে, অভিযুক্তদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের বাড়িতেও কয়েক দফা পুলিশ গেছে। কিন্তু তাঁরা পলাতক।নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সংস্থাপন মন্ত্রণালয় ও বিজি প্রেসের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে প্রভাবশালী অনেকের নাম এসেছে। বিশেষ করে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়, ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন এবং অনেক সরকারি কর্মকর্তার নাম এসেছে। এ কারণে ঘটনা অন্য খাতে চলে যেতে পারে বলে তাঁরা আশঙ্কা করছেন।গত বছরের ৯ জুলাই সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর আগের দিন রংপুরে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়ায় পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। প্রাথমিকভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে ঘটনাস্থল রংপুরের ভিন্নজগৎ থেকে ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর বিজি প্রেসের চার কর্মচারীসহ গ্রেপ্তার হন আরও ১১ জন। কিন্তু সবাই বর্তমানে জামিনে মুক্ত।এ ঘটনায় করা মামলার তদন্তের দায়িত্বে প্রথমে ছিল রংপুরের ডিবি পুলিশ। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রংপুরের সিআইডির উপপরিদর্শক (এসআই) অজিজুল ইসলাম এবং তত্ত্বাবধানকারী কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার লুৎফুর রহমান।মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে লুৎফুর রহমান গতকাল বলেন, তদন্তকাজ চলছে। তবে অভিযোগপত্র জমা দিতে আরও কয়েক মাস লেগে যাবে। মামলার প্রয়োজনে আরও কাউকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। শহীদুলকে কেন গ্রেপ্তার বা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শহীদুল হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হলে আদালত থেকে অনুমতি নিতে হবে। সেই প্রক্রিয়া চলছে। আর মামলার স্বার্থে তাঁকে অবশ্যই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.