শরিফুল হাসান
এই দেশের প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলিক্রসের মতো নীতি নৈতিকতা শেখানো উচিত-এমন কথা আমি প্রায়ই বলি। আজ সেই হলিক্রস স্কুলের এক ছাত্রীর আত্মহত্যার খবরে ভীষন মর্মাহত হয়েছি। আহত হবার একটা বড় কারণ পরীক্ষার ফল নিয়ে এক ছাত্রীর আত্মহত্যা। যে মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে তার নাম পারপিতা ফাইহা (১৪)।
হলিক্রস স্কুলের নবম শ্রেণীর সি শাখার ছাত্রী ছিল এই কিশোরি। রোল ১। সংকটটা এখানেই। রোল ১ কেন ফেল করবে?সহপাঠীরা বলেছে, এ বছর প্রথম সাময়িক পরীক্ষায় উচ্চতর গণিতে সি এবং ডি শাখার ১০২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ জনকে ফেল করে। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায়ও উচ্চতর গণিতে ৫৫ জন ফেল করে। পারপিতাও এই দলে।
পরপর একই বিষয়ে দুই বার ফেল করায় স্কুলের অধ্যক্ষ পারপিতার অভিভাবককে বৃহস্পতিবার দেখা করার নির্দেশ দেন। এই খবর পেয়ে সোমবার থেকে পারপিতা আতঙ্কে ছিল। সে তার বাবা মাকে বিষয়টি জানায়নি। মঙ্গলবার স্কুলে সহপাঠীদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপও করে। কিন্তু কোনও উপায় বের করতে পারেনি।
মঙ্গলবার বিকেলে স্কুল থেকে বাসায় ফিরে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করে। আমি দেখলাম এখানে কেউ কেউ এখানে শিক্ষকের প্রাইভেট বানিজ্যের কথাও বলছেন। আবার পারপিতার পরিবারের বিরুদ্ধেও ফল খারাপ করলে নিপীড়নের অভিযোগ আছে। আগেই বলেছি, ১৪ বছরের কিশোরী পারপিতার আত্মহত্যার খবরে ভীষণ আহত হয়েছি।
আসলে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গোটা ব্যবস্থায় গলদ। এ এখানে যেভাবে পরীক্ষা নেওয়া হয়, প্রত্যেককে প্রকাশ্যে পরীক্ষার নাম্বার দেওয়া হয়, এরপর রোল নম্বর দেওয়া হয়, কে প্রথম হলো, কে দ্বিতীয় এসব নিয়ে আলোচন হয়, অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানদের নম্বর ফেসবুকে দেন, তারা যে কোন মূল্যে সন্তানের ভালো ফল চান, জিপিএ ৫ পেয়েছে ভেবে আনন্দে থাকেন, এগুলোর পুরোটাই হতাশাজনক!
এই যে গণহারে জিপি দেওয়া, জিপিএর জন্য আমাদের অভিভাবক থেকে শুরু করে গোটা সমাজ যেভাবে লালায়িত থাকে সেগুলো নিয়ে আমার যথেষ্ঠ আপত্তি আছে। এই দেশে কেজি ক্লাসের বা প্রাইমারির লেখাপড়া দেখলে আপনি আঁতকে উঠবেন। অথচ পৃথিবীর বহু দেশে প্রাথমিক পর্যন্ত সেভাবে লেখাপড়া না করিয়ে বাচ্চাদের মনোবিকাশ শেখানো হয়। আমরা বলছি বাচ্চাদের পরীক্ষা নেব না কিন্তু পরীক্ষা ছাড়া কোন স্কুল নেই।
রাজ্যের সব মুখস্ত থেকে শুরু করে ছোট একটা বাচ্চাকে যোগ বিয়োগ থেকে শুরু করে বিসিএস পরীক্ষার মতো সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করানো হয়। ছেলে মেয়েদের যেন ফার্স্ট হতেই হবে জিপিএ ৫ পেতেই হবে। অথচ দিনশেষে আমাদের লেখপড়ার মান নিয়ে নানা প্রশ্ন আছে!আসলে এই দেশে লেখাপড়ায় সৃজনশীলতার সুযোগ সীমিত, শিক্ষা এখানে ব্যবসা।
এখানে দূরদর্শি কোন পরিকল্পনা নেই, বরং কয়দিন পরপর নতুন নতুন পদ্ধতি নেয়া হয়। এছাড়া একই দেশে নানা ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষক নিয়োগে নানা সমস্যা, বেতন বৈষম্য, সৃজনশীলতার নামে মুখস্থ, লাখ লাখ ছেলেমেয়ের জিপিএ লড়াই, এরপর ভর্তিযুদ্ধ, বিসিএস বা চাকরির নামে লড়াই, নিজের সাফল্য, সবসময় নিজের কথা ভাবা, চাকরি না পেলে হতাশা, সবমিলিয়ে ভয়াবহ অবস্থা।
জানি না এগুলোর শেষ কোথায়?আমি মনে করি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ গলদ আছে। এখানে স্কুল-কলেজ-বিশ্বিবদ্যালয়ে জিপিএ আর সনদ দেওয়া হয় সত্যিকারের মানুষ তৈরি কতোটা হয় তা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। এরমধ্যেই যখন ফেসবুকে বা অন্য কোথাও পড়ি যে মানুষ তৈরির চেষ্টা করে হলিক্রস, ফেল করলে কখনো অভিভাক ডাকে না কিন্তু কোথাও চিপসের প্যাকেট ফেললে কড়া শাসন করে।
মানবিকতা আর মূল্যবোধ শেখায় তখন ভীষণ ভালো লাগে।আমি তো প্রায়ই নানা আড্ডায় বলি, দেশের প্রত্যেকটা স্কুলের হলিক্রসের মতো পরিবেশ হওয়া উচিত। সেই হলিক্রসের এক ছাত্রীর আত্মহত্যা তাও ফেল করা নিয়ে ভীষণ দুঃখজনক। আশা করি পারপিতার মৃত্যুর পর হলিক্রস কর্তৃপক্ষ আলোচনায় বসবে এবং কোথাও কোন সমস্যা আছে কী না সেটা খুঁজে বের করবে।আমি জানি এদেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর আরো ভয়াবহ দশা।
আসলে আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমাদের ভাবা দরকার। অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষক শিক্ষার্থী সবার মনোজগতে পরিবর্তন দরকার। দরকার শিক্ষা ব্যবস্থার সত্যিকারের মূল্যায়ন। নয়তো আরো অনেক পারপিতা আত্মহত্যা করবে। আর যারা বেঁচে থাকবে তাদের অধিকাংশই সত্যিকারের মানুষ হবে না। অথচ শিক্ষার উদ্দেশ্য ছিলো মূল্যবোধসম্পন্ন সত্যিকারের মানুষ তৈরি করা।
আশা করছি আমরা আমাদের সন্তানদের সুস্থভাবে বিকশিত করতে এবং সত্যিকারের মানুষ তৈরি করতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আমরা নতুন করে ভাববো। কারণ শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড! আর আমাদের সেই মেরুদন্ডে যথেষ্ট গলদ আছে। আমাদের সবার আগে সেই সমস্যার স্বীকার করতে হবে এবং এরপর সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। আশা করছি আমাদের শিক্ষক শিক্ষার্থী অভিভাবক নীতি নির্ধারক সবার বোধ জাগবে।



