নয় ওয়ার্ডে ইভিএম
শরিফুল হাসান
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নয়টি ওয়ার্ডে ইভিএম (ইলেকট্রনিক ভোটিংমেশিন) ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। ইভিএম ব্যবহারে আপত্তি করছেন বিএনপি-সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। অন্য দুই প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও শামীম ওসমান অবশ্য ভোট গ্রহণে ইভিএমের ব্যবহার মেনে নিয়েছেন।এদিকে ভোটারদের ইভিএমের ব্যবহার শেখাতে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডগুলোয় প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন। যাঁরা প্রশিক্ষণ নিয়েছেন, তাঁরা ইভিএমকে সহজ একটি প্রযুক্তি হিসেবে মেনে নিয়েছেন। তবে যাঁরা কর্মশালায় অংশ নেননি, এটি নিয়ে তাঁরা এখনো গোলকধাঁধার মধ্যে আছেন।তবে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা বিশ্বাস লুৎফর রহমান বলেন, ইভিএম নতুন কিছু নয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে একটি ওয়ার্ডে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দ্বিতীয়বারের মতো এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। এ নিয়ে আতঙ্কিত কিংবা বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। নির্বাচনের আগেই কর্মশালা ও মহড়া ভোটের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবাইকে ইভিএমে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে দেওয়া হবে। ইভিএমে ভোট কারচুপির কোনো সুযোগ নেই বলে তিনি জানান।চলছে কর্মশালাইভিএমে ভোট দেওয়ার নিয়ম জানাতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ডগুলোয় কর্মশালার আয়োজন করছে নির্বাচন কমিশন। ১৭ অক্টোবর ৭, ২২ ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়। ১৮ অক্টোবর ৮, ১৭ ও ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটারদের ইভিএম প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।কর্মশালা সম্পর্কে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ফরহাদ হোসেন জানালেন, ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার পুরো বিষয়টি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের হাতে-কলমে শেখাচ্ছেন তাঁরা। এই প্রশিক্ষণ কর্মশালা ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত চলবে। ২৫, ২৬ ও ২৭ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলোয় ভোট গ্রহণের মহড়া অনুষ্ঠিত হবে। এতে পোলিং এজেন্ট, প্রার্থীর প্রতিনিধি ও ভোটারদের উপস্থিতি থাকবে।এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইভিএম প্রশিক্ষণ কর্মশালায় ভোটাররা সেভাবে আসছেন না। বিশেষ করে মহিলা ভোটারদের উপস্থিতি খুবই কম। এ বিষয়ে ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘বিশৃঙ্খলা এড়াতে এ বিষয়ে আমরা কোনো মাইকিং করছি না। ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে প্রশিক্ষণের জন্য আনা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে এই প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা কার্যক্রম চলবে। নির্বাচন কমিশন চায় প্রত্যেক ভোটার অথবা কমপক্ষে প্রতিটি পরিবারের একজনকে এই পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিতে।’ভোটারদের ভাবনা২২ নম্বর ওয়ার্ডে ইভিএম নিয়ে কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন মুঠোফোনের ব্যবসায়ী ফরহাদ উদ্দিন। তিনি বলেন, নতুন একটি পদ্ধতি। সেটি দেখতেই তিনি কর্মশালায় গিয়েছিলেন। বিষয়টি তাঁর কাছে সহজ মনে হয়েছে। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ধনকুন্ডা পপুলার হাইস্কুলে ইভিএম কর্মশালায় যোগ দিয়েছিলেন কলেজছাত্র আমিনুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ইভিএম নিয়ে অযথাই ভয় পেয়েছিলাম। আমি বিষয়টি দেখেছি। এমন কঠিন কিছু নয়।’১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট প্রদানবিষয়ক কর্মশালা থাকলেও তাতে যোগ দেননি ওই ওয়ার্ডের ১ নম্বর বাবুরাইল এলাকার ব্যবসায়ী নাজমুল হোসেন। কেন কর্মশালায় যাননি, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কাজকর্ম ফেলে কে ইভিএম শিখতে যাবে? ভোটের দিনই যা শেখার শিখে নেব।’ইভিএম সম্পর্কে জানতে চাইলে শহরের একটি পোশাক কারখানার কর্মী নাজমা বেগম বলেন, ‘আমি জানি না এটি দেখতে কেমন। এটি যদি আমার পরিচিত কোনো মেশিনের মতো হয়, তাহলে আমি এতে ভোট দিতে পারব। জটিল হলে আমি ভোট দিতে পারব কি না, জানি না।’১৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাইকপাড়া প্রাইমারি স্কুলে ১৮ অক্টোবর দেড় হাজারের মতো ভোটার ইভিএমের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তাঁদের একজন রেজাউল ইসলাম বলেন, তিনি অনেক কিছু দেখেছেন। কিন্তু আবার সব ভুলে গেছেন। তবে ভোটের দিন তিনি ভোট দিতে পারবেন বলে আশা করছেন।কারচুপির সুযোগ নেইনির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছেন, ইভিএমে হ্যাকিং বা ফলাফল কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। নারায়ণগঞ্জে ভোটার ও প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে এসে তিনি বলেন, ‘আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়েই ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। শঙ্কার কোনো কারণ নেই। ইভিএম ব্যবহারে ফলাফল বিপর্যয়ের কোনো সম্ভাবনা যদি থাকত, তাহলে নির্বাচন কমিশন কখনোই তা করত না। অনেকে ই-ভোটিং ও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনকে গুলিয়ে ফেলছেন। ইভিএম নিয়ে কারও সন্দেহ থাকলে দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ নিয়ে আসতে পারেন। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখুন। আমাদের প্রমাণ করে দেখানো হোক, এই মেশিনে কারচুপির বা হ্যাকিংয়ের সুযোগ আছে।’ছহুল হোসাইন আরও বলেন, প্রতিটি ভোট প্রদানের পর এর পোলিং এজেন্ট তা দেখতে পাবেন। তাই এর ফলাফল পাল্টে ফেলার কোনো সুযোগ নেই। কাজেই প্রার্থীরা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।যেখানে ব্যবহারনির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে নয়টিতে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে: ৭, ৮, ৯, ১৬, ১৭, ১৮, ২২, ২৩ ও ২৪। এই নয়টি ওয়ার্ডের ৫৮টি কেন্দ্রের ৪৫০টি বুথে ইভিএম ব্যবহার করা হবে। এর মাধ্যমে ভোট দেবেন এক লাখ ৪৮ হাজার ২৯ জন ভোটার।যেভাবে ভোট দিতে হবেইভিএম ব্যবহারে নির্বাচন কমিশনকে কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইআইসিটি)। ১৪ অক্টোবর বিকেলে শহরের জিয়া হলে ইভিএম ব্যবহার করে ভোট প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে নির্বাচন কমিশন। সভায় প্রার্থীদের ইভিএম প্রদর্শন করে এর মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দেন বুয়েটের আইআইসিটির পরিচালক ড. এস এম লুৎফুল কবীর।লুৎফুল কবীর বলেন, ইভিএম পদ্ধতিতে দুটি অংশ থাকবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে কন্ট্রোল ইউনিট, অন্যটি ব্যালট ইউনিট। কন্ট্রোল ইউনিট পরিচালনা করবেন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা। আর গোপন বুথে থাকবে ব্যালট ইউনিট। আগে যেমন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের ব্যালট পেপার দিতেন, এখন তিনি সেখানে কন্ট্রোল ইউনিট থেকে বাটন চাপলেই ভোটার ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। ভোটারদের সামনে যে বাটন আসবে, তাতে তাঁরা মেয়র, সংরক্ষিত কাউন্সিলর ও সাধারণ কাউন্সিলর—এই তিনটি প্যানেলে ভোট দিতে পারবেন। পছন্দের প্রতীক ও প্রার্থীর নামের পাশের বোতামে চাপ দিলেই সবুজ বাতি জ্বলে উঠবে। ভোট দেওয়া শেষ হলে ‘বিপ’ শব্দ করে লাল বাতি জ্বলবে। প্রতিটি ভোটের পর ডিসপ্লেতে দেখা যাবে কতজন ভোটার ভোট দিলেন। এখানে ভোট বাতিল হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।লুৎফুল কবীরের মতে, অন্যান্য দেশে ব্যবহূত ইভিএমে সাধারণত ডিসপ্লে থাকে না। কিন্তু বাংলাদেশে যে ইভিএম ব্যবহার করা হচ্ছে, তাতে ডিসপ্লে থাকবে। ভোটার ভোট দেওয়ার পর পোলিং এজেন্ট তা সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পাবেন। কন্ট্রোল ইউনিটটি স্মার্ট কার্ড দ্বারা পরিচালিত হয়। তাই এতে অন্য কারও পক্ষে ভোট দেওয়া সম্ভব হবে না। আর ফলাফল পাল্টানোরও কোনো সুযোগ নেই।



