দৈনিক বাংলা

Spread the love

শরিফুল হাসান

রাত পোহালেই কাল ৪ সেপ্টেম্বর থেকে দেশে আসছে আরো একটি নতুন পত্রিকা দৈনিক বাংলা। দুই যুগ আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া পত্রিকাটি নতুন আঙ্গিক ও ব্যবস্থাপনায় প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আসলে নতুন কোন পত্রিকা আসলে আমি এক ধরনের ঈদের আনন্দ অনুভব করি। Dainik Bangla নিয়েও সেই আনন্দ হচ্ছে। দৈনিক বাংলা পত্রিকাটির ইতিহাস বেশ পুরোনো। পাকিস্তান আমলে এর নাম ছিল দৈনিক পাকিস্তান।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে দৈনিক পাকিস্তানের নাম পরিবর্তন করে দৈনিক বাংলা রাখা হয়। বদলে যাওয়া ওই দৈনিক বাংলার প্রথম সম্পাদক ছিলেন তোয়াব খান। ইতিহাসের কী অদ্ভুত মিল! বন্ধ হয়ে যাওয়ার ২৫ বছর পর সেই তোয়াব খানের নেতৃত্বেই আবার দৈনিক বাংলা প্রকাশ হতে যাচ্ছে। দৈনিক বাংলার নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আছেন প্রথম আলোয় আমার চীফ রিপোর্টার ও এক যুগের সহকর্মী Sharifuzzaman Pintu ভাই। অবশ্য শুধু পিন্টু ভাই নয় তানভীর ভাই, নোমান ভাই, হারুন ভাই থেকে শুরু করে একটা বড় অংশই প্রথম আলোয় আমার সহকর্মী ছিলেন।

প্রথম আলোর বাইরে থেকে আর এসেছেন তাদেরও বেশিরভাগকে চিনি। আবার অনেক তরুণ সাংবাদিকও আছে সেখানে। একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য সবার মধ্যে আছে সেটা হলো তারা ভালো মানুষ এবং সাংবাদিকতা করার চেষ্টা করেন। আগেই বলেছি, নতুন কোন পত্রিকা আসলে আমি এক ধরনের ঈদের আনন্দ অনুভব করি। সেই ছোটবেলা থেকেই এটা হয়েছে। আমার পত্রিকা পড়া আর অ আ ক খ শেখা প্রায় কাছাকাছি সময়ে। বাবার সরকারি চাকুরির সুবাদে আমরা বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সারকারখানার সরকারি কলোনীতে আমরা থাকতাম।

চট্টগ্রাম শহর থেকে এই জায়গাটা বেশ দূরে। ফলে সেখানে পত্রিকা পৌঁছাতে বিকেল হয়ে যেতো। যাই হোক, বিকেলের দিকে আমি বারান্দায় বসে থাকতাম হকারের জন্য। হকার যখন পত্রিকা নিয়ে আসতো আর সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল বাজাতো আমি দৌড়ে দোতালা থেকে নিচে গিয়ে পত্রিকা নিয়ে আসতাম। হকারকে দোতালা পর্যন্ত উঠতে হতো না বলে সেও বেশ খুশি ছিলো। আর আমি বাসার সবার আগে পত্রিকা ধরতে পেরে, নতুন কাগজের গন্ধ নিতে পেরে মহাখুশি হতাম। হকারের কাছ থেকে কাগজ এনে আমি অবাক চোখে তাকাতাম। আমি তখন সংবাদগুলো বুঝতাম না, কিন্তু বানান করে করে পড়তে ভালো লাগতো। ইত্তেফাক দিয়ে শুরু হয়েছিল আমার দৈনিক পত্রিকা পড়া।

এরপর আজকের কাগজ, জনকণ্ঠ, মুক্তকণ্ঠ, ভোরের কাগজ থেকে শুরু করে প্রথম আলো যখন যে নতুন পত্রিকা এসেছে সেটা রেখেছি। একটি বিষয় না বললেই নয়, সরকারি চাকুরি করা বাবার যে বেতন সেই টাকা দিয়ে আমাদের পরিবারের খুব স্বচ্ছলভাবে চলার সুযোগ ছিলো না। তাই মাঝে মাঝেই কথা উঠতো বাসায় পত্রিকা নেয়া বন্ধ করে দেবে কী না। কিন্তু পত্রিকা বন্ধ করার কথা উঠলেই আমি কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম।

এই কারণেই কখনো পত্রিকা বন্ধ হয়নি। বরং খুব ছোটবেলা থেকেই সংবাদপত্রের প্রতি আমার এক ধরনের ভালোবাসার জন্মে। এই যে ছোটবেলা থেকে সংবাদপত্রের প্রতি ভালোবাসা সেটি আজো আছে। ২০০২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই নিজেই সাংবাদিকতায় যুক্ত হই। এরপর যখন যে পত্রিকা এসেছে উদ্বোধনী সংখ্যাটা আমি রেখেছি। কয়েকদিন পড়েছি। ভালো লাগলে একাধিক পত্রিকা রেখেছি। এখনো একাধিক পত্রিকা রাখি। নিজে টানা বিশ বছর ধরে কম-বেশি সাংবাদিকতা করেছি এবং বিশ্বাস করি, একটি সংবাদ একজন মানুষের জীবন যেমন বদলে দিতে পারে, তেমনি বদলে দিতে পারে সমাজ-রাষ্ট্রও। আমি আসলেই বিশ্বাস করি গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ।

এই চতুর্থ স্তম্ভ যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করে, তাহলে রাষ্ট্রের বাকি তিন স্তম্ভ (আইন সভা, নির্বাহী বিভাগ ও বিচার বিভাগ) সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করবে বলে আমি মনে করি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন থমাস জেফারসন একবার বলেছিলেন, ‘আমাকে যদি বিকল্প দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে দুর্ভিক্ষ হানা দিতে পারে না। এসব কথার সারমর্ম একটাই- গণতন্ত্র ও দেশের স্বার্থেই স্বাধীন সাংবাদিকতা দরকার।

কিন্তু সেই স্বাধীন সাংবাদিকতা নানান ভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। যারা ক্ষমতায় থাকেন কিংবা রাষ্ট্রযন্ত্র শুধু নয়, মালিকপক্ষের স্বার্থও স্বাধীন সাংবাদিকতা কম বাঁধা নয়, বরং এই সেলফ সেনশরশীপই বড় বাঁধা। আশা করি দৈনিক বাংলার মালিকপক্ষ ও প্রকাশকরা সত্যিকারের স্বাধীনতা দেবেন যাতে করে গণমানুষের দৈনিকে পরিনত হয় দৈনিক বাংলা।

আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে। ৫০ বছর আগের দৈনিক বাংলা আর আজকের দৈনিক বাংলার মধ্যেকার সময়ের পার্থক্য পাঁচ দশক। এই সময়ে মানুষের চিন্তাভাবনা এবং সংবাদপত্রের ধারাসহ অনেক কিছু বদলে গেছে।

কাজেই নতুন সময়ের নতুন চাহিদার সাংবাদিকতা করতে হবে।দৈনিক বাংলার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। রোজ ভোরের শিউলি ফুল হয়ে উঠুক দৈনিকটি। নতুন দিনের শুরুতে ভোরে পথে নামা অনেক মানুষ যেমন শিউলি কুড়িয়ে আনন্দ পায় দৈনিক বাংলা হোক তেমনি একটি দৈনিক। অনেক অনেক শুভ কামনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published.