‘প্রচণ্ড গোলাগুলিতে উড়ছিল আগুনের ফুলকি’
শরিফুল হাসান
‘পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সব স্টেশন, আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে আমাদের আক্রমণ করেছে। আপনারা আত্মরক্ষা করার জন্য তৈরি হন।’২৫ মার্চ কালরাতে সারা দেশের সব পুলিশ স্টেশনে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যিনি ইংরেজিতে এই বার্তাটি ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর নাম শাহজাহান মিয়া। এ বার্তার মাধ্যমেই রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পাকিস্তানি হামলার খবর জানতে পারেন পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। শাহজাহান মিয়া তখন সেখানকার বেতার অপারেটর ছিলেন। একান্ত আলাপচারিতায় প্রথম আলোকে সেই রক্তক্ষয়ী ও গৌরবময় প্রতিরোধের কাহিনি শোনালেন মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান মিয়া। বললেন ২৫ মার্চের পরের অনেক অভিজ্ঞতার কথাও। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা আভাস পাই পঁচিশে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আক্রমণ হতে পারে। আমরা বুক ফুলিয়ে প্রতিরোধের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি তখন ওয়্যারলেস বেইজ স্টেশনের দায়িত্বে। তেজগাঁও পেট্রলপাম্প থেকে রাতে একটি মেসেজ আসে, ‘পাকিস্তানি সেনাভর্তি ৩৭টি ট্রাক নগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।’ রাত সাড়ে ১১টার দিকে সেনারা পুলিশ লাইন ঘিরে ফেলে। এর কিছুক্ষণ পরই আক্রমণ করে তারা।শাহজাহান মিয়া বলে চলেন, ‘পাকিস্তানিরা বিদ্যুতের লাইন কেটে দিয়েছিল। জেনারেটর চালু করতে গিয়েও পারলাম না। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে রাজারবাগে আগুনের ফুলকি উড়তে লাগল। আমি চারতলার ছাদে আশ্রয় নিয়েছিলাম। একটা থ্রি নট থ্রি নিয়ে লড়াই করে চলেছি। ওদের কাছে অনেক ভারী অস্ত্র। সারা রাত যুদ্ধ হলো। ফজরের আজান পর্যন্ত আমিসহ ১০০ জনের মতো পুলিশ টিকে ছিলাম। ভোর পাঁচটার দিকে আমাদের ঘিরে ফেলে বন্দী করে আর্মি।’ পাকিস্তানি সেনারা ওই পুলিশ সদস্যদের আটকে রেখে চরম নির্যাতন করে। ২৮ মার্চ বেলা সোয়া তিনটার দিকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পুলিশ সুপার ই এ চৌধুরীর জিম্মায় মুক্তি পান শাহজাহান। পরে চার দিন হেঁটে নেত্রকোনার কেন্দুয়ার বাট্টা গ্রামের বাড়িতে পৌঁছান। শাহজাহান মিয়ার মনের ভেতর তখন যুদ্ধ চলছে। মা-বাবার টান। ঘরে নতুন বউ। কিন্তু মনে বাজে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। ‘আমি তখন এদিক-সেদিক ছুটি। যোগাযোগ করি সবার সঙ্গে’, বলেন এ মুক্তিযোদ্ধা। ১০ এপ্রিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মহেশখলায় যান শাহজাহান। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁকে। শাহজাহান মিয়া তাঁর অংশ নেওয়া কয়েকটি যুদ্ধের বর্ণনা দিলেন। মহেশখলা থেকে তাঁরা সিলেটের ধরমপাশা থানা আক্রমণ করেন। প্রচুর অস্ত্র গোলাবারুদ উদ্ধার করেন সেখান থেকে। সরকার-সমর্থক ওসি হেকিম চৌধুরীকে অপহরণ করে মহেশখলা নিয়ে যান। এরপর জুলাই মাসে মুক্তিফৌজের সুবেদার আজিজুল হকের নেতৃত্বে নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার পাকিস্তানি সেনাঘাঁটি আক্রমণ করেন তাঁরা। ওই পক্ষের অস্ত্রের জোর ছিল অনেক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঘাঁটিটি দখল করতে পেরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। শাহজাহান মিয়া বলেন, ‘অস্ত্রের শক্তি নয়, আমাদের মনের শক্তি ছিল অনেক বেশি।’ ৫ ডিসেম্বর একটি যুদ্ধে আহত হন শাহজাহান মিয়া। তিনি বলেন, ‘দুর্গাপুর থানার বিজয়পুর সেনাঘাঁটিতে হামলার সিদ্ধান্ত হলো। আমাদের সঙ্গে মিত্র বাহিনীর একজন মেজর ও মুক্তিফৌজের কমান্ডার। সারা রাত যুদ্ধ হলো। ৬ ডিসেম্বর ঘাঁটিটা দখল করলাম। এ যুদ্ধের সময় মাইন বিস্ফোরণে একজন আদিবাসী মুক্তিযোদ্ধার দুটো পা-ই বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আমার ডান পা ক্ষত-বিক্ষত হয়।’



