শরিফুল হাসান
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জের বিশ্রামকক্ষে বসে আছেন বিলকিস বেগম। এভারেস্ট জয় করে তাঁর ছেলে আজ ঘরে ফিরছেন। মুখে আনন্দের হাসি, কিন্তু চোখ দুটো ছলছল। একই অবস্থা বাবা আনসার আলীরও।মা-বাবার পাশাপাশি মুসার প্রতীক্ষায় গতকাল দুপুর থেকে বিমানবন্দরে জড়ো হন প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, মুসার নর্থ আলপাইন ক্লাবের সদস্য-শুভানুধ্যায়ী, সাংবাদিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। বিমানবন্দরের বাইরে কয়েক হাজার মানুষ। সবার অপেক্ষা মুসাকে এক নজর দেখার। কখন আসবে এভারেস্ট জয় করা বাংলাদেশের স্বপ্নতরুণ মুসা ইব্রাহীম!বিকেল চারটা ১৬ মিনিটে বিমানবন্দরের রানওয়ে স্পর্শ করল মুসাকে বহনকারী কোরিয়ান বহুজাতিক কোম্পানি ইয়ংওয়ানের বিশেষ বিমান পি-১৮০ অ্যাভান্টি-টু। দেড় বছরের ছেলে ওয়াসি ইব্রাহীমকে নিয়ে নামলেন মুসার স্ত্রী সরাবন তহুরা, বোন নূর আয়েশা, বোনের স্বামী রাশিদুল হাসান ও নর্থ আলপাইন ক্লাবের সভাপতি আনিসুল হক। সবশেষে বিমান থেকে নেমে দৃপ্ত পায়ে হেঁটে এলেন মুসা। মাথায় লাল-সবুজ পতাকা। রানওয়ে থেকে বিমানবন্দরে ঢোকার পর মুসাকে একনজর দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন উপস্থিত সবাই। চারপাশে ক্যামেরার ক্লিক। হাত নেড়ে উপস্থিত সবাইকে শুভেচ্ছা জানালেন মুসা। বললেন, ‘এ বিজয় বাংলাদেশের। এ বিজয় সবার।’ এভারেস্ট জয়ের অনুভূতি জানাতে গিয়ে তিনি বললেন, ‘বাংলাদেশকে পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় ওঠানোর অনুভূতিটা সত্যি অন্য রকম, এটা কখনোই পুরোপুরি ভাষায় ব্যক্ত করা যাবে না। এ অভিযানে আমার সঙ্গে ছিল গোটা বাংলাদেশ আর বাংলাদেশের সব মানুষ।’এর আগে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে স্থানীয় সময় দুইটায় বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন মুসা ইব্রাহীম। কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে তাঁকে বিদায়ী শুভেচ্ছা জানান নেপালে বাংলাদেশ দূতাবাসের উপমিশন-প্রধান নাসরিন জাহান। উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও। বাংলাদেশ বিমানের পক্ষ থেকেও সেখানে মুসাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। ঢাকায় ছেলের অপেক্ষায় থাকা বিলকিস বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না এ অনুভূতি। কত দিন পর ছেলেটাকে দেখব। সবার স্বপ্ন পূরণ করেছে আমার ছেলে। কিন্তু আমি সব সময় উৎকণ্ঠায় ছিলাম। সব সময় অপেক্ষা করেছি ছেলেটা যেন আমার নিরাপদে নেমে আসতে পারে।’শুভেচ্ছা জানাতে আসা সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, ‘মুসার সাফল্যে আমাদের জীবনে জয় ও উচ্চতা শব্দ দুটো অর্থবহ হলো। মুসা সর্বোচ্চ শিখর জয় করেছেন। এর আগে মুসা ছিলেন আমাদের অল্প কিছু মানুষের প্রিয়জন। কিন্তু আজ মুসা বাংলাদেশের সব মানুষের আপনজন।’ যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাংসদ জাহিদ আহসান বলেন, মুসা প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের তরুণেরা চাইলেই অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।বিমানবন্দরে উৎসবের আমেজ: মুসাকে বহনকারী বিমান রানওয়ে ছোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তারক্ষীদের বিশেষ পাহারায় ভিআইপি লাউঞ্জের সিঁড়ি দিয়ে তাঁকে নামানো হয়। সেখানে নিজের অনুভূতি জানান মুসা, ‘দেশের স্বপ্ন পূরণ করে আমি প্রচণ্ড খুশি।’ বিমান থেকে নামার পর মুসাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি জাহিদ আহসান, পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস, প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে মুসাকে শুভেচ্ছা জানান তাঁর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান ও প্রটোকল কর্মকর্তা প্রলয় জোয়ার্দ্দার। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে একটি গাড়িতে করে বাইরে বেরিয়ে আসেন মুসা। প্রথম আলো বন্ধুসভা ও নর্থ আলপাইন ক্লাবের সদস্য ছাড়াও বিমানবন্দরের বাইরে তখন কয়েক হাজার মানুষ। সেখানে ফুল ছিটিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয় মুসাকে। অনেকে মুসা ইব্রাহীমের নামে স্লোগান দেন। হাত নেড়ে শুভেচ্ছার জবাব দেন মুসা।পথে পথে শুভেচ্ছা: বিমানবন্দর থেকে বিশেষ পাহারায় গাড়িতে করে কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আসেন মুসা ইব্রাহীম। পথে পথে তাঁকে শুভেচ্ছা জানান উৎসুক জনতা। গাড়িতে আসতে আসতেই মুসা শোনাচ্ছিলেন তাঁর এভারেস্ট জয়ের নানা ঘটনা। ৫৫ দিন টিকে থাকার সংগ্রামের কথা।মুসা ইব্রাহীম বললেন, ‘আমি আমার সমস্ত শক্তি এক করেছিলাম। অন্য সব ভাবনা বাদ। আমার একটাই চিন্তা ছিল, যেকোনো মূল্যে এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে হবে। শেষের কয়েকটা দিন তো না খেয়েই ছিলাম। এভারেস্ট জয় বাদে অন্য কিছুই আমাকে টানছিল না।’গাড়িতে আসতে আসতে দীর্ঘদিন পর নিজের মোবাইল সেটটি সচল করলেন মুসা। মুহূর্তেই অসংখ্য সংক্ষিপ্ত বার্তা। সবাই শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। প্রিয়জন ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কয়েকটি বার্তা পড়েন তিনি। অনেকেই ফোনে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। গাড়িতে নর্থ আলপাইন ক্লাবের সভাপতি আনিসুল হক মুসাকে নিয়ে দেশবাসীর আশার কথা বলছিলেন। ক্লাবের সাংগঠনিক সম্পাদক মাসুদুল হাসান ও নির্বাহী সম্পাদক মাহবুবা রহমানকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা শোনাচ্ছিলেন মুসা। কথার এক ফাঁকে বাদাম এগিয়ে দিয়ে নাট্যব্যক্তিত্ব শহিদুল আলম বললেন, প্রথম বাঙালি মুসলমান হিসেবে এভারেস্ট জয় করায় মুসাকে বাদাম খাওয়াচ্ছেন। প্রথম আলোয় মুসা: প্রথম আলোর কর্মীরা কারওয়ান বাজারে কার্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করছিলেন মুসার জন্য। মুহূর্তেই সামনের রাস্তা মানুষে ভরে গেল। গাড়ি থেকে নামার পর সেখানে তাঁকে শুভেচ্ছা জানালেন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন। তারপর ফুল ছিটিয়ে শুভেচ্ছা। ভিড় ঠেলে মুসা উঠে এলেন প্রথম আলো কার্যালয়ে। মুসাকে দেওয়া হয় বিশেষ সংবর্ধনা। অনুষ্ঠানে জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, ‘পত্রিকা দেখে ২৪ মে খুব সকালে ঘুম ভাঙিয়ে মুসার এভারেস্ট জয়ের সংবাদটি দেন আমার স্ত্রী। সংবাদটি আমাকে প্রচণ্ড আনন্দিত করে। সাম্প্রতিক সময়ে এত আনন্দিত আর আমি হইনি।’ ইনাম আল হক বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমার একটি কষ্ট ছিল। এ পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশি এভারেস্ট জয় করেনি, এমনকি জয়ের চেষ্টাও করেনি। মুসা আমাদের সেই কষ্ট দূর করেছে।’আনিসুল হক বলেন, ‘১৬ কোটি মানুষের কৃতিত্ব মুসা ইব্রাহিমের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সেই সংবাদ প্রকাশ করতে পেরে প্রথম আলো ধন্য হয়েছে।’প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘মুসা আমাদেরই একজন। মুসা সব অর্জন করেছে তাঁর একক প্রচেষ্টায়। আমরা কেবল তাঁকে সহায়তা করেছি।’অনুষ্ঠানে মুসা ইব্রাহীম বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের প্রতিধ্বনি হয়ে এভারেস্টে আমি বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। এ অর্জন সবার। আমি বিশ্বাস করি, কেউ যদি কোনো ভালো কাজ করার চেষ্টা করে তাহলে সফল হবেই। আসুন আমরা ভালো কিছু করার চেষ্টা করি। ভালো কিছু করতে সহায়তা করি।’প্রথম আলো কার্যালয় থেকে মুসা যান ডেইলি স্টার ও চ্যানেল আইয়ের কার্যালয়ে। পরে যান তাঁর প্রিয় প্রতিষ্ঠান নর্থ আলপাইন ক্লাব অব বাংলাদেশে (এনসিবি)। মুসা এই ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক। গণভবনে মুসামুসা ইব্রাহীমকে গণভবনে ডেকে নিয়ে অভিনন্দন জানালেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল রাত নয়টায় মুসা ইব্রাহীম স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মাসহ গণভবনে যান। খুশিতে আত্মহারা প্রধানমন্ত্রী মুসাকে দেখে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দেন। তাঁর সঙ্গে উপস্থিত মন্ত্রী, সাংসদ ও আওয়ামী লীগের নেতারাও জয় বাংলা ধ্বনি দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করেন।প্রধানমন্ত্রী মুসাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘মুসার এভারেস্ট জয়ে প্রমাণিত হলো, বাঙালিরা পারে।’ তিনি মুসার স্ত্রী ময়মনসিংহের সহকারী জেলা জজ উম্মে সরাবন তহুরাসহ বাবা-মাকে অভিনন্দন জানান। মুসা ইব্রাহীম বলেন, ‘আপনারা আমার এ বিজয়কে বাংলাদেশের বিজয় হিসেবে দেখায় আমি খুশি।’ তিনি বলেন, এ রকম ভালো উদ্যোগে সহায়তা পেলে এ দেশের তরুণেরা অনেক দূর যেতে পারবে।