আলো ও লাইফ জ্যাকেট নেই, একের পর এক দুর্ঘটনা

Spread the love

নিয়ম ভেঙে রাতের পদ্মায় ঝুঁকি নিয়ে চলছে স্পিডবোট

শরিফুল হাসান


রাতের নিকষ আঁধারে পদ্মা নদীতে চলে দ্রুতগতির স্পিডবোটগুলো। একটি বোটেও আলো নেই। নেই লাইফ জ্যাকেট। তবু মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌপথে অসংখ্য মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে এ স্পিডবোটেই নদী পার হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে নৌযানগুলোকে বলে সি-বোট।এদিকে রাতে স্পিডবোট চলা নিষেধ থাকলেও আইন কার্যকর করার দায়িত্ব যাদের, সেই পুলিশ এ ব্যাপারে নির্বিকার বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অভিযোগ। রাতে পদ্মায় প্রায়ই দুর্ঘটনায় পড়ছে স্পিডবোটগুলো। সম্প্রতি দুটি স্পিডবোটের সংঘর্ষে মারা গেছেন এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুজন। এর কিছুদিন আগে অপর এক দুর্ঘটনায় এক জেলের মৃত্যু হয়। গত ১০ ও ১১ ডিসেম্বর এই নৌপথে গিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে সমস্যাটির নানা দিক জানা যায়। যাত্রীরা জানান, লঞ্চে নদী পার হতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগে। কিন্তু স্পিডবোটে লাগে মাত্র ২০ মিনিট। ফলে বেশি টাকা লাগলেও বহু মানুষ স্পিডবোটে নদী পার হয়। মোটা আয়ের আকর্ষণ: ভালো আয়ের নিশ্চয়তা থাকায় স্পিডবোটের মালিকেরা নিয়মনীতি অমান্য করে রাতে বোট চালান। নিয়ম অনুযায়ী, সন্ধ্যার পর যেকোনো স্পিডবোট চলার কথা নয়, সে কথা স্বীকার করে স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও বোট মালিক সমিতি সবাই। কিন্তু তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। মাওয়া নৌ-ফাঁড়ির পুলিশের বিষয়টি তদারকির কথা থাকলেও তারা কখনোই তা করে না বলে স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ। এর পেছনে অসাধু লেনদেন থাকতে পারে বলেও জোরালো ইঙ্গিত দিয়েছেন অনেকে।প্রায়ই দুর্ঘটনা: পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনসহ সবার গোচরেই স্পিডবোটগুলো সন্ধ্যার পরও চলে। এগুলোতে রাতের নৌপথে চলতে প্রয়োজনীয় সার্চ লাইটজাতীয় উজ্জ্বল আলোর ব্যবস্থা থাকে না। যাত্রীরা বলেছেন, প্রায় বোটেই সাধারণ টর্চলাইট পর্যন্ত রাখা হয় না। গত ৮ ডিসেম্বর রাত আটটায় ১০ জন যাত্রী নিয়ে মাওয়া ঘাট ছেড়ে আসা একটি স্পিডবোট শিবচরের কাঁঠালবাড়ী এলাকায় পৌঁছালে বিপরীত দিক থেকে আরেকটি স্পিডবোটের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। মাওয়া থেকে আসা বোটটির সামনের অংশ ভেঙে গিয়ে সেটি নদীতে ডুবে যায়। আধঘণ্টা পর একটি স্পিডবোট গিয়ে চালক ও আট যাত্রীকে উদ্ধার করে। দুর্ঘটনার পরের দুই দিনে একজন করে দুই নিখোঁজ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। তাঁরা হলেন, বঙ্গভবনে কর্মরত পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ নেছারউদ্দিন (৫০) ও জনৈক মহিউদ্দিন মোল্লা (২৪)। এ দুর্ঘটনাটির পরও প্রশাসনের তরফ থেকে বিশেষ কোনো তৎপরতা না থাকায় ১৪ ডিসেম্বরই একই এলাকায় আবার স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ১০ জন আহত হয়। কিছুদিন আগে স্পিডবোট-ট্রলার সংঘর্ষে মারা যান এক জেলে। সারা বছরই ঘটে এমন ছোটখাটো দুর্ঘটনা। আলো নেই, জ্যাকেট নেই: নিয়ম অনুসারে স্পিডবোটের প্রত্যেক যাত্রীর জন্য লাইফ জ্যাকেট থাকার কথা থাকলেও কখনোই তা রাখা হয় না। যাত্রীদের অভিযোগ, মাওয়া নৌ-ফাঁড়ির পুলিশ কখনোই এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। ৮ ডিসেম্বরের দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যবসায়ী মাসুদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুই স্পিডবোটের সংঘর্ষে আমি ডুবে যাই। দীর্ঘ আধঘণ্টা ভেসে ছিলাম। কিন্তু দুজন মারা গেছেন। লাইফ জ্যাকেট থাকলে তা হতো না।’ আবদুস সালাম, আবদুল মজিদসহ আরও কয়েকজন যাত্রী বলেন, ‘লঞ্চগুলো যখন ১৮ টাকা ভাড়া নেয়, সেখানে স্পিডবোট নেয় দেড় শ টাকা। কাজেই প্রত্যেক যাত্রীর জন্য একটি করে লাইফ জ্যাকেট রাখা উচিত।’মাদারীপুরের নাসিরউদ্দিন বলেন, ‘অনেক সময় যাত্রীদের মুঠোফোনের আলো জ্বালিয়ে তারা চলে। মানুষের জীবন নিয়ে এত হেলাফেলা হতে পারে, এই স্পিডবোটে না উঠলে কেউ তা টের পাবে না।’সাগর, মজনুসহ স্পিডবোটের কয়েকজন চালক বলেন, বিকন বাতি প্রায়ই বন্ধ থাকায় কোনো দিক খুঁঁজে পাওয়া যায় না। কর্তৃপক্ষ বলছে, যন্ত্রাংশ চুরি হয়ে যাওয়ায় বিকন বাতিগুলো সব সময় সচল রাখা যায় না। নানা অব্যবস্থাপনা: কাওড়াকান্দি ও মাওয়া ঘাটে তিন শর বেশি স্পিডবোট চলাচল করে। জনপ্রতি নেওয়া হয় ১২০ টাকা। কিন্তু এত টাকা নেওয়ার পরও যাত্রীদের বোটে ওঠা-নামার সুব্যবস্থা নেই। মাদারীপুরের জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বাঁশের ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে সি-বোটে উঠতে হয়। প্রায়ই এই সিঁড়িও পানিতে ডুবে থাকে। মাদারীপুরের স্কুলশিক্ষিকা জেসমিন আকতার বলেন, সকালবেলা কাউন্টারগুলো বন্ধ থাকে। এ সময় ১২০ টাকার ভাড়া ১৫০ টাকা রাখা হয়।‘অসহায়’ নৌপুলিশ: ভুক্তভোগীদের মূল অভিযোগ মাওয়ার নৌ-ফাঁড়ির পুলিশের বিরুদ্ধে। তাদের অভিযোগ, নদীপথের নিরাপত্তা না দেখে তারা ব্যস্ত থাকে সড়কে গাড়ির চাঁদাবাজিতে। মাওয়া নৌ-ফাঁড়ির পুলিশের ইনচার্জ তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা নামেই নৌপুলিশ। দুর্ঘটনা না ঘটলে আমাদের কিছু করার নির্দেশ নেই। তাই আমরা কখনোই নদীতে যাই না। সরঞ্জামও নেই। কিছু করতে গেলে সি-বোট মালিকেরা আমাদের হুমকি দেয়।’সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যা বলেন: কাওড়াকান্দি ঘাটের স্পিডবোট মালিক-চালকদের অভিযোগ, তাঁদের ঘাটে নিয়মকানুন মানা হয়। কিন্তু মাওয়ায় কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কাওড়াকান্দি সি-বোট মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে স্পিডবোট যারা চালায়, তারা চুরি করে চালায়। …আমরা লাইফ জ্যাকেট ও বয়া রাখার জন্য চালকদের নির্দেশ দিয়েছি। কিন্তু তারা কেউ মানে না।’মাদারীপুরের শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিপুলচন্দ্র বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এ ব্যাপারে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ শিবচর থানার ওসি আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাতে স্পিডবোট চলায় বারবার দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও বিভিন্ন অপরাধ হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.