আতঙ্ক পিছু ছাড়েনি কাদেরের, যুক্ত হয়েছে সমঝোতার চাপ

Spread the love

শরিফুল হাসান

আবদুল কাদের
আবদুল কাদের

লেখাপড়া শেষ করে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হয়েছেন। বিয়ে করেছেন। একটি ছেলেও হয়েছে। সবকিছু মিলে সুখে থাকার কথা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র আবদুল কাদেরের। কিন্তু পুলিশের হাতে নির্যাতিত কাদেরের পিছু ছাড়েনি আতঙ্ক, তাই পুরোপুরি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি। এর ওপর যুক্ত হয়েছে পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে করা মামলায় সমঝোতার জন্য নানাভাবে চাপ।
আবদুল কাদের এখন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক। ইউনিয়ন পরিষদের শেষ ধাপের নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের জন্য ৪ জুন কুমিল্লায় গেলে দেখা হয় তাঁর সঙ্গে। পুলিশের নির্যাতন, বর্তমান জীবন, মামলাসহ নানা বিষয়ে কথা হয়। বললেন, মানসিক আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এর ওপর শুরু হয়েছে সমঝোতা করার চাপ।
২০১১ সালের ১৬ জুলাই রাতে ইস্কাটনে খালার বাসা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্র কাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ফেরার পথে সেগুনবাগিচা থেকে খিলগাঁও থানার পুলিশ আটক ও নির্যাতন করে। পরে নেওয়া হয় খিলগাঁও থানায়। পরদিন থানায় নির্যাতনের একপর্যায়ে তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হেলালউদ্দিন চাপাতি দিয়ে কাদেরের পায়ে আঘাত করেন। পরে পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে এবং দস্যুতার অভিযোগে দুটি মামলা করে। তাঁকে আদালতে পাঠানো হলে আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠান।

এ ঘটনার প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন এবং ঘটনাটি তদন্তে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন। ওই ঘটনায় আইন মন্ত্রণালয় ও পুলিশের তদন্ত কমিটি কাদেরকে নির্দোষ উল্লেখ করে হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ওই পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে পাল্টা মামলা করেন কাদের। নির্যাতনের ওই মামলায় গত বছরের মে মাসে সাবেক ওসি হেলালউদ্দিনকে তিন বছরের কারাদণ্ডাদেশ এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেন মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন হেলাল। গত এক বছরেও শুরু হয়নি ওই আপিলের শুনানি। প্রতিবারই আদালতে সময় বাড়ানোর আবেদন করে আসামিপক্ষ। বর্তমানে জামিনে থাকা হেলাল সাময়িক বরখাস্ত অবস্থায় পুলিশের ঢাকা রেঞ্জে সংযুক্ত আছেন।

৩৩তম বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ পান কাদের। প্রথম কর্মস্থল ছিল লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজ। সেখান থেকে গত বছরের জুনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে বদলি হন। ৫ জুন কাদেরের সঙ্গে আবার কথা হয় ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজে, সম্মান তৃতীয় বর্ষের ক্লাস নেওয়া শেষে।

কাদেরের স্ত্রী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। গত বছর তাঁদের একটি ছেলে হয়েছে। চাকরি, স্ত্রী, সন্তান—সবই তো হলো। আপনি তো এখন সুখী মানুষ—এমন প্রশ্নে কাদের বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা অনেক কিছুই দিয়েছেন। আমার এখন খুব সুখে থাকার কথা। কিন্তু ওই যে পুলিশের নির্যাতন, সে কারণে আজও আমি স্বাভাবিক হতে পারিনি। এখনো গায়ে ব্যথা হয়। বেশি পরিশ্রম করতে পারি না। আর মানসিক আতঙ্ক এখনো কাটেনি। এর মধ্যেই শুরু হয়েছে নতুন চাপ, যন্ত্রণা। সমঝোতা করতে হবে!’

কাদের বলেন, ‘মামলাটি বর্তমানে ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত আছে। আমাকে ওই পুলিশ কর্মকর্তার (হেলাল) পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে ক্ষমতা আছে, এমন মানুষ প্রতিনিয়ত ফোন করছেন। তাঁরা চান, আমি যেন এই মামলায় সমঝোতা করি। আমি যেন ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে ক্ষমা করে দিই। কিন্তু আমি ক্ষমা করার কে? ওই পুলিশ কর্মকর্তা সংবাদ সম্মেলন করে জাতির কাছে ক্ষমা চাক। বলুক, আর কোনো দিন কেউ আমার মতো নির্যাতিত হবে না। আমি তাহলে ক্ষমা করে দেব। আর এখনো যদি আদালত থেকে ওই পুলিশ কর্মকর্তা খালাস পান, আমার কিছু বলার নেই। কিন্তু আমাকে কেন এত যন্ত্রণা দেওয়া হচ্ছে?’

কাদেরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শুধু চাপ নয়, টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করতেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে হুমকিও দেওয়া হচ্ছে তাঁকে। বলা হচ্ছে, একজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে যাওয়ার ফল ভালো হবে না।

আবদুল কাদেরের আইনজীবী আবদুল গাফফার গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর মামলার রায় হওয়ার পরপরই আসামিপক্ষ আপিল করে। আসামিপক্ষ প্রভাবশালী। এ পর্যন্ত ১১ বার তাঁরা শুনানির সময় পেছানোর আবেদন করেছেন। প্রতিবারই তাঁরা আদালতে বলেন, বাদীর সঙ্গে সমঝোতার চেষ্টা চলছে। এভাবে তাঁরা সময় নিচ্ছেন। সময় নেওয়ার পর কাদেরকে চাপ দেওয়া হয়।’

হেলালউদ্দিনের আইনজীবী ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সমঝোতার জন্য সময় চাওয়া হয় না। অন্য কারণে আদালতে কয়েকবার সময় চাওয়া হয়েছে। তবে এখন মামলাটি আর আমি দেখছি না।’

কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ আবদুর রশিদ বলেন, ‘কাদের আমারই সহকর্মী। কয়েক দিন আগে ওই পুলিশ কর্মকর্তার পরিবার আমার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছে। বলেছে, আমি যেন সমঝোতার বিষয়ে কাদেরের সঙ্গে কথা বলি। কাদেরকে ঘটনাটি জানিয়েছি। কাদেরের মতো আমরাও ওই নির্যাতনের ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.