পথে পথে গ্রেপ্তার মৃত্যু হয়রানি
শরিফুল হাসান
মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, ইরাকসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ; রোমানিয়া, ইতালি, গ্রিসসহ ইউরোপ; দক্ষিণ আফ্রিকা, মালদ্বীপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর অবৈধভাবে লোক পাঠাচ্ছে দালালেরা। সরকারি হিসাবে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার বাংলাদেশি কারাগারে আছেন। বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার মালয়েশিয়ায় অবৈধ বাংলাদেশিদের বৈধ করা হচ্ছে। এ সুযোগে মালয়েশিয়ায় ছাত্র ও পর্যটক সাজিয়ে শ্রমিক পাঠানো শুরু করে দালালেরা। টাস্কফোর্স ও অভিবাসন পুলিশ গত তিন মাসে বিমানবন্দরে অভিযান চালিয়ে মালয়েশিয়াগামী বিমান থেকে প্রায় সাড়ে ৬০০ লোককে নামিয়ে এনেছে। কিন্তু কয়েক দিন পর আবার দালালেরা তাঁদের পাঠানোর উদ্যোগ নেয়। কারণ, দালালদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এশিয়ার অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়ার সমন্বয়ক হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ এ প্রবণতা ঠেকাতে না পারলে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্প্রতি কক্সবাজারের টেকনাফে একটি ট্রলারডুবির পর সমুদ্রপথে দালালদের মালয়েশিয়ায় লোক পাঠানোর বিষয়টি নজরে আসে। উদ্ধার হওয়া লোকজন জানান, তাঁদের মালয়েশিয়ায় নেওয়া হচ্ছিল। ওই ট্রলারের ২৫ যাত্রী এখনো নিখোঁজ। গত এক মাসে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিজিবি ও পুলিশ মালয়েশিয়াগামী এমন ৮৭ জনকে আটক করেছে। থানায় মামলা হয়েছে। অনুপ্রবেশকারী মিয়ানমারের রোহিঙ্গাও এভাবে বাংলাদেশি সেজে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের জন্যও বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার নষ্ট হচ্ছে। জিয়ারতের নামে ইরাক, ওমরাহর নামে সৌদি আরব: ইরাকের বাংলাদেশ দূতাবাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বর্তমানে ৪০ হাজারের মতো বাংলাদেশি আছেন। অথচ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) বলছে, ইরাক যুদ্ধের পর বৈধভাবে দেশটিতে গেছেন মাত্র দুই হাজার ৮৮৭ জন বাংলাদেশি। তার মানে বাকি প্রায় ৩৮ হাজার লোক দালালদের মাধ্যমে অবৈধপথে ইরাকে গেছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে কুয়েত হয়ে অবৈধভাবে লোকজন ইরাকে প্রবেশ করেন। গত বছর কুয়েত সীমান্তে গ্রেপ্তার হন ৫২ বাংলাদেশি। অবৈধভাবে লোক যাচ্ছেন সৌদি আরবেও। বায়রার মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী জানান, ওমরাহ হজের ভিসা নিয়ে গিয়ে প্রতিবছর অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ হাজার লোক সৌদি আরবে থেকে যান। তাঁরা পরে অবৈধ হয়ে পড়েন। এই অবৈধ ইস্যুতে বহুদিন ধরে সেখানকার শ্রমবাজারে অচলাবস্থা চলছিল। ইউরোপের স্বপ্ন দেখিয়ে প্রতারণা: রোমানিয়ায় ৩০০ লোক পাঠানোর কথা বলে ২০০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন দেয় এক্সপার্ট ওভারসিজ। মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনের লোভ দেখিয়ে সাড়ে ৩০০ লোকের কাছ থেকে দেড় থেকে তিন লাখ করে টাকা নেওয়া হয়। প্রতারিত ব্যক্তিদের একজন শফিউল্লাহ খান জানান, বারবার তারিখ দিলেও তাঁদের কাউকেই রোমানিয়ায় পাঠানো হয়নি। পরে প্রতিষ্ঠানটির মালিক গোলাম মোস্তফার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং বিএমইটিতে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। ব্যস, এ পর্যন্তই। প্রতিবছর হাজারো লোক ইউরোপে যাওয়ার নামে প্রতারিত হচ্ছে। সাত থেকে আট লাখ টাকা নিয়ে দালালেরা ইউরোপের যেকোনো দেশে পাঠাচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের। গত মার্চে স্পেনে শতাধিক বাংলাদেশি গ্রেপ্তার হয়েছেন। রোমানিয়া থেকে অবৈধভাবে ইতালি প্রবেশ করতে গিয়ে গত এপ্রিলে গ্রেপ্তার হয়েছেন ১০ জন। দক্ষিণ আফ্রিকায়: আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক হয়ে সড়কপথে দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রবেশ করতে গিয়ে এ বছরের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪২ বাংলাদেশি। একইভাবে এ বছরের শুরুতে গ্রেপ্তার হন আরও ৩৭২ বাংলাদেশি। বছরজুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ছয়জন। বাজার নষ্ট লিবিয়ায়: কর্নেল মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর বাংলাদেশ থেকে একটি চক্র অবৈধভাবে লোক পাঠানো শুরু করে লিবিয়ায়। অক্টোবর মাসে মিসর হয়ে লিবিয়ার বেনগাজি দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ১৩ জন বাংলাদেশি আটক হন। লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) আহসান কিবরিয়া সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, দালাল চক্র মিসর, সুদান, নাইজার, শাদ ও আলজেরিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের লিবিয়ায় অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। এর ফলে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দ্রুত এ ব্যাপারে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। নেপাল হয়ে ভিন্ন দেশ: অভিবাসন পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, দালালেরা সম্প্রতি কর্মী নিচ্ছে নেপালে। এরপর সেখান থেকে মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানো হচ্ছে। কয়েক দিন আগে এভাবে বিদেশে যেতে গিয়ে নেপাল থেকে দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন মেহেরপুরের ১৯ জন তরুণ। ৫০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি মালদ্বীপে: সরকারি হিসাবে বৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে কাজ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো কর্মী মালদ্বীপে যাননি। অথচ দেশটিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার বাংলাদেশি আছেন।



