শরিফুল হাসান
কজন মানুষ মুক্তিযোদ্ধা শুধু এই একটি কারণেই তিনি বিশেষ শ্রদ্ধার যোগ্য। আর তিনি যদি হন তেমন মুক্তিযোদ্ধা যিনি আমৃত্যু দেশের মঙ্গলের জন্য সততার সাথে লড়ে গেছেন তাহলে তো তাকে ভালো না বেসে উপায়ে নেই! আমার চোখে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন ছিলেন তেমনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা যার লড়াইটা ছিল আজীবন।
পেশায় স্থপতি মানুষটা সারাক্ষণ যেন মনে মনে এই দেশটার ডিজাইন করতেন! আর তাই স্বাধীন এই বাংলাদেশের প্রায় সব সংকটে তিনি সামনে থাকতেন, কাজ করতেন, পরামর্শ দিতেন, প্রয়োজনে লড়াই করতেন। এমন সাহসী, স্পষ্টবাদী এবং ন্যায়নিষ্ঠ মানুষ হাতে গোনা এই বাংলাদেশে! ভাবতে ভালো লাগে ব্যক্তিগতভাবে মানুষটাকে চিনতাম বিশেষ করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ে দারুণভাবে চিনেছি তাকে।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগে শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলেন মোবাশ্বের হোসেন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চে গণহত্যা শুরুর দু’দিন আগে দেশের পরিস্থিতি বুঝে তাঁর মা আপ্রান চেষ্টা করেছিলেন তাঁকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে। কিন্তু জন্মভূমির চরম দুঃসময়ে তিনি স্বদেশ ছেড়ে নিরাপদে বিলেতে চলে যাননি।
স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরুর পূর্বেই তিনি বিয়ে করেন ও সন্তানের পিতা হন । একবার ভাবুন তো পিতা হয়ে সন্তান ও স্ত্রীকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখে রেখে যুদ্ধে যাচ্ছেন তিনি। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোবাশ্বের হোসেন দেশের কাছে সব মায়া-ভালবাসা তুচ্ছ করেছিলেন। তবে কথায় কথায় তিনি নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ব্যবহার করতেন না বরং সচেতনভাবেই অতি সযত্নে তিনি তা লুকিয়ে রাখতেন।
বরং বারবার বলতেন, যে চাষী, রিকশাচালক, শ্রমিক আমাদের মুক্তিরযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছেন তাঁদের অবদান গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনের চাইতে কোটিগুণ বেশী। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীর বিক্রমের অধীনে।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে দেশের অভ্যন্তরে তিনি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলেন। অবরুদ্ধ ঢাকায় পরিচালিত সর্বশেষ গেরিলা অপারেশন সংঘটিত হয়েছিল ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে। আমেরিকান কালচারাল সেন্টারে (ইউসিস ভবন নামে পরিচিত) এই গেরিলা হামলা চালানো হয়েছিলো। গেরিলারা ইউসিস আক্রমণ করে আমেরিকার কাছে সতর্কবাণী পাঠাতে চেয়েছিলেন।
এই বীর মুক্তিযোদ্ধার ভাষাতেই তুলে ধরলাম সেই অভিযানের কথা, “আমেরিকান সেন্টার (ইউসিস বিল্ডিং)সহ কয়েকটা অপারেশন করা হবে। গোপীবাগে আমার বাসায় অস্ত্র নিয়ে আসা হবে। এখন রেললাইনের ওপারে যেটা বিশ্বরোড ১৯৭১ সালে সেটা ছিল পুরা গ্রাম। গ্রাম থাকার কারণে ওপারে মুক্তিযোদ্ধাদের যাতায়াত অনেক সহজ ছিল।
তখনকার রেললাইন এখনকার বিশ্বরোডের ওপরে ছিল পাকিস্তানি আর্মিদের চেকপোস্ট। সে সময় ঢাকা শহরে অস্ত্র গোলাবারুদ ঢোকাতে হলে যাত্রাবাড়ীর মানিকনগরের এসব গ্রামাঞ্চল দিয়েই আনা হতো। গোপীবাগ রেলগেট পর্যন্ত আমার এক বন্ধুর গাড়ি দিয়ে অস্ত্রগুলো আনার কথা। রাস্তার অপর পাড় পর্যন্ত অস্ত্র নিয়ে আসা হয়েছে কিন্তু যানবাহন ও অন্যান্য সুযোগের অভাবে শহরে ঢোকাতে পারছি না।
আমার আজও মনে আছে সে সময় হেঁটে হেঁটে একবার গোপীবাগের বাসায় যাচ্ছি দেখতে যে, গাড়িটা আসছে কিনা? আবার ঐ জায়গায় যাচ্ছি।হঠাৎ একটা বাচ্চা ছেলে ১০ কি ১১ বছর বয়স হবে। আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলে, ‘স্যার কিছু আনন লাগবো?’ আমি তখনও তার কথার অর্থ কিছু বুঝিনি। সে আমার পেছনে হাঁটছে আর কিছুক্ষণ পরপর বলছে স্যার কিছু আনন লাগবে, কিছু আনন লাগবে? এরপরে দেখা গেল আমার যে বন্ধুর গাড়ি নিয়ে আসার কথা সে আসেনি। আমাকে অস্ত্রগুলো নিয়ে আসতে হবে।
ঐ কিশোর ছেলেটি যাকে আমি জানি না, চিনি না তার ওপর বিশ্বাস করতে হবে। আমি তখন তাকে বললাম, হ্যাঁ, কিছু আনতে হবে। তখন আমি ডেসপারেট, যে কোনো প্রকারেই হোক অস্ত্র আমার বাসায় আনতেই হবে। কেননা মাত্র দুদিন পরেই আমাদের অপারেশনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা আছে। তখন তো বাস্তবের অনেক অঙ্ক আমরা কষতাম না। তখন আমাদের একটাই লক্ষ্য, যেটা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটা বাস্তবায়ন করতেই হবে। কিভাবে সেটা করা যাবে, সেটা ভিন্ন বিষয়।
কিন্তু সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয়েছে তখন যে কোনো উপায়েই হোক বাস্তবায়ন করতেই হবে। যা হোক আমি ঐ ছেলেটাকে নিয়ে আমার বাসা চিনিয়ে দিলাম। আমার অস্ত্রের ভাণ্ডার দেখিয়ে দিলাম। ঘণ্টাখানেক পরে দেখলাম একটা ব্যাগের মধ্যে ডাঁটার শাকের মাথা বের হয়ে আছে, আর ও ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে বাংলা সিনেমার গান গাইতে গাইতে, মানিকনগর থেকে ব্যাগের মধ্যে অস্ত্র নিয়ে দুবারে আমার বাসায় পৌঁছে দিয়ে গেল। আজ পর্যন্ত আমি ঐ ছেলেটাকে খুঁজছি। কিন্তু মানিকনগরের ঐ মানিককে আজো আমি খুঁজে পাইনি।মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমরা অনেক বাগাড়ম্বর করি।
কিন্তু এই ছেলেটির মতো লোকদের অবদানের কথা বলি না। আমার নিজের মুক্তিযুদ্ধে যে অবদান তার শতগুণ করলেও এই ছেলেটির অবদানের সমান হবে না। ছেলেটির এই যে সাহস, আমার মনোভাব পড়তে পারার তার যে গুণ এবং নিঃস্বার্থভাবে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসম্ভব বীরত্বের এই যে কাজটি করা, তার তো তুলনা হয় না।
আমি নিশ্চিত আমার মতো অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে সে এভাবে সহায়তা করেছে। আমার আজো মনে আছে, কাঁধের ভেতরে ব্যাগে শাকের আঁটির মধ্যে আমাদের কিছু এক্সপ্লোসিভ, দুটো স্টেনগান নিয়ে সে বাংলা ছবির, “এমন মজা হয় না গায়ে সোনার গয়না……”, গানটি গাইতে গাইতে দু’তিনবার আমার বাসায় পৌঁছে দেয়। এরপর তাকে আর কোনোদিন দেখিনি। মাঝেমধ্যে মনে হয় সে কি মানুষ ছিল নাকি অন্য কিছু? এই স্মৃতিগুলো আমি ভুলিনি কখনো। এই স্মৃতিগুলোই আমাকে সাহস জোগায় সৎ চিন্তা করতে, সৎ পথে থাকতে। মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্টেনগান কাঁধে আমার নিজের এই ছবিটা সবসময় আমার টেবিলের পাশে রাখি।
অনেকে বলেন এই ছবি কেন এখানে রাখেন! আমি এই ছবিটা এখানে রাখি তার একটি মাত্র কারণ, আমার যেন পদস্খলন না হয়, প্রতিক্ষণে এই ছবিটা যেন আমাকে পাহারা দেয়।”আসলেই আজীবন সৎপথে থেকেছেন এই গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। বেশ কিছু দিন হাসপাতালে অচেতন থাকার পর গতরাতে তাঁর দেহাবসান হয়। জানাজা শেষে তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুসারে তাঁর মরদেহ বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে দান করা হবে।
ব্যক্তিগতভাবে স্থপতি মোবাশ্বের হোসেনকে আমি ভীষণ শ্রদ্ধা করতাম। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি এই মানুষটি চট্টগ্রাম রেলস্টেশন, প্রশিকা ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক ভবনসহ উল্লেখযোগ্য অনেক ভবনের নকশা করেছেন। তবে তাকে ভালো লাগার একটা বড় কারণ নাগরিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সাবেক পরিচালক ছিলেন।
দেশের ক্রীড়াঙ্গনের বিশেষ করে বিসিবির যে কোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ধানমন্ডি মাঠ ও তেঁতুলতলা মাঠ নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে ছিলেন। আমার সবসময় মনে হতো আজীবন তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে লালন করেছেন অন্তরে। কষ্ট লাগছে এই কারণে যে মানুষটা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন! স্যালুট হে বীর মুক্তিযোদ্ধা!