শরিফুল হাসান
দীর্ঘ ছয় বছর অপেক্ষার পর অবশেষে এল সুখবর। এই সুখবর হলো, বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিয়েছে সৌদি আরব। গতকাল রোববার সৌদি আরবের রাজকীয় সভায় (রয়েল কোর্ট) এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করা হয়। এতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজারে আবার কর্মী যাওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত হলো।
সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং ঢাকার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, জনশক্তি রপ্তানির প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করতে সৌদি সরকারের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ঢাকায় আসবে।
দূতাবাস সূত্র জানায়, গতকাল সৌদি শ্রম মন্ত্রণালয়ের একজন উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের খবর জানান। এরপর রাষ্ট্রদূত ঢাকায় জরুরি ফ্যাক্সবার্তা পাঠিয়ে এ খবর জানান।
যোগাযোগ করা হলে সৌদি আরবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলাম গতকাল মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘সৌদি রয়েল কোর্ট বাংলাদেশ থেকে কর্মী নেওয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। দেশটির শ্রম মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ডেপুটি মিনিস্টার আহমেদ আল ফাহাইদ গতকাল আমাকে ফোন করে সুখবরটি জানান। এখন থেকে বাংলাদেশি কর্মী আসতে আর বাধা নেই।’
কবে নাগাদ কর্মী নিতে পারে জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘সৌদি সরকারের একজন মন্ত্রীর নেতৃত্বে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই প্রতিনিধিদল ঢাকায় যাবে। এই সফরেই খরচসহ সবকিছু চূড়ান্ত হবে।’
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরব। ১৯৭৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬৩ জন বাংলাদেশি সৌদি আরবে গেছেন। শেষের দিকে প্রতিবছর গড়ে দেড় থেকে দুই লাখ কর্মী সেখানে গেছেন। কিন্তু ২০০৮ সালের শেষে নতুন করে ভিসা দেওয়া বন্ধ করে দেয় সৌদি আরব। কিছু বাংলাদেশির অপরাধপ্রবণতা এবং জামায়াতে ইসলামীর অপপ্রচারের কারণেই এমন সিদ্ধান্ত আসে বলে মনে করেন প্রবাসীরা। বর্তমানে দেশটিতে ১৫ থেকে ২০ লাখ বাংলাদেশি আছেন।
সৌদি আরবে কর্মী যাওয়া বন্ধ হওয়ার প্রভাবে জনশক্তি রপ্তানি অর্ধেকে নেমে আসে। সৌদি সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের ইকামা (কাজের অনুমতিপত্র) বদলেরও সুযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েন বাংলাদেশিরা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে সৌদি আরব সফরে গিয়ে বাদশাকে আবার কর্মী নেওয়ার, ইকামা ও পেশা পরিবর্তন এবং সাধারণ ক্ষমার সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানান। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা শহীদুল ইসলামকে সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হয়। তিনি যোগ দিয়ে সৌদি সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। পাশাপাশি বাংলাদেশিদের অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনতেও পদক্ষেপ নেন। ২০১২ সালের মার্চে ঢাকায় সৌদি দূতাবাসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা খালাফ আল আলী খুন হন। এরপর রাষ্ট্রদূত নিহত খালাফের পরিবারসহ সৌদি সরকারের কর্মকর্তাদের সুষ্ঠু তদন্তের ব্যাপারে বারবার আশ্বস্ত ও পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন।
বন্ধ এই শ্রমবাজার চালু করতে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন পাঁচবার সৌদি আরব সফর করেন। তিনি সৌদি শ্রমমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রিয়াদের তৎকালীন গভর্নরসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তৎপর ছিলেন। এ ছাড়া সৌদি স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিনিধিদল ২০১৩ সালের মার্চের শেষে বাংলাদেশ সফর করে।
সৌদি সরকার ২০১৩ সালের ১০ মে থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সেখানে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশিদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। একই সঙ্গে ইকামা ও পেশা পরিবর্তনেরও সুযোগ দেয়। সাত লাখ ৯৯ হাজার ১৮৬ জন বাংলাদেশি সাধারণ ক্ষমার এই সুবিধা পান।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল সর্বশেষ গত ১৮ থেকে ২৩ জানুয়ারি পর্যন্ত সৌদি আরব সফর করে। এই সফরে তিনি সৌদি শ্রমমন্ত্রীর পাশাপাশি দেশটির তৎকালীন ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স (বর্তমান ক্রাউন প্রিন্স) মুকরিন বিন আবদুল আজিজের সঙ্গে বৈঠক করেন। এই সফরেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রীকে আশ্বস্ত করা হয়।
দূতাবাস সূত্র জানায়, চার বছরের মেয়াদ শেষ হওয়ায় রাষ্ট্রদূত শহীদুল ইসলামকে মালয়েশিয়ায় বদলি করে সরকার। আগামীকাল ৩ ফেব্রুয়ারি তাঁর সৌদি আরবে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ছাড়ার কথা। তিনি দায়িত্ব ছাড়ার দুই দিন আগেই সৌদি সরকার তাঁকে ফোন করে বাজার উন্মুক্ত করার খবর দেয়।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আগে সৌদি আরবে কর্মী যেতে জনপ্রতি ছয় থেকে সাত লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হতো। কিন্তু এবার সেই খরচ কমিয়ে আনা হবে। প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী ২৫ জানুয়ারি আলাপকালে প্রথম আলোকে বলেন, এবার সর্বোচ্চ ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা খরচ হতে পারে। কারণ ভিসা, মেডিকেল ফি, কর্মীর বিমানভাড়া—সবই দেবে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ।
সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, সবকিছু ঠিক থাকলে দেশটির প্রস্তাবিত ছয়টি মেগাসিটি এবং বাংলাদেশিদের পরিচালনাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কয়েক লাখ কর্মীর কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব খন্দকার মো. ইফতেখার হায়দার বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছয় বছর অপেক্ষার পর বাংলাদেশের শ্রমবাজারের সবচেয়ে বড় সুখবরটি এল সৌদি আরব থেকে। আমরা আশা করছি খুব কম খরচেই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি সেখানে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।’