মাদকই যে জেলার প্রধান সমস্যা
শরিফুল হাসান
চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি নরসিংদীর শিবপুরে খুন হন জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন কাদের। তাঁর পরিবার ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও এলাকার মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ায় তাঁকে খুন করা হয়৷
সর্বশেষ গত ১৩ মে নরসিংদী সদরের ঘোড়াদিয়া এলাকায় খুন করা হয় ১৬ বছরের কিশোর জসীম মিয়াকে৷ জসীমের পরিবারও অভিযোগ করে, এলাকায় মাদক ব্যবসায় বাধা দেওয়ার কারণেই তাকে খুন হতে হয়৷
নরসিংদীতে গত পাঁচ দিনে বিভিন্ন শ্রেিণ-পেশার অনেক মানুষের সঙ্গে কথা হয়৷ সবার কাছে প্রশ্ন ছিল, এই জেলার প্রধান সমস্যা কী? ঘুরেফিরে প্রায় সবাই একিটর কথাই বলেছেন—মাদক৷ এই মাদকের কারণেই প্রায় সব অপরাধ ঘটছে৷ জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্যও একই কথা বলছে৷
১৯৯৯ সালের মে মাসে এই নরসিংদী শহরেই স্পিরিট পান করে ১১৩ জনের মৃত্যু হয়, যা দেশের অন্যতম মাদক ট্র্যাজেডি হয়ে আছে৷
নরসিংদী জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে জেলার ছয়টি থানায় বিভিন্ন অভিযোগে মোট এক হাজার ১৬টি মামলা হয়েছে৷ এর মধ্যে ২৭০টিই মাদকসংক্রান্ত মামলা৷ এর মধ্যে ১৪৬টি মামলাই হয়েছে নরসিংদী সদরে৷ মাদকের পর সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে নারী নির্যাতনের—১৩৬টি। এ ছাড়া গত পাঁচ মাসে ৪৩টি খুন, ৫২টি চুরি, অস্ত্র আইনে ১৬টি, ডাকাতি-রাহাজানির ২০টি ও চোরাচালানের চারটি মামলা হয়েছে৷ পুলিশ বলছে, অন্য যে মামলাগুলো হয়েছে, এর অনেকগুলোর সঙ্গেও মাদকের যোগসাজশ আছে৷ যদিও গত বছরের প্রথম পাঁচ মাসের তুলনায় (৩৬৮টি) চলতি বছরের একই সময়ে মাদকের মামলা কমেছে৷
জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলার ৭০টি স্পটে নিয়মিত মাদক কেনাবেচা চলে৷ চলতি বছরে প্রথম পাঁচ মাসে মাদকবিরোধী ১৮০টি অভিযান চালানো হয়েছে৷ এ সময় মাদকসহ গ্রেপ্তার হয়েছে ৭৪ জন। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতে ৪৪টি মামলা হয়েছে৷ টাস্কফোর্সে মামলা হয়েছে ২৮টি৷ জেলার মাদক ব্যবসায়ী কারা, জানতে চাইলে পুলিশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে৷ আর খুচরা ব্যবসায়ীদের বেশির ভাগই নারী৷
নরসিংদীর সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) এ কে এম জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছেও অন্যতম সমস্যা মাদক৷ খুচরা মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনেক নারী আছেন৷ এ ছাড়া বাচ্চাদের স্কুলের ব্যাগেও অনেক সময় মাদক পরিবহন করা হয়৷ তবে পুলিশ সব সময়ই মাদকের বিরুদ্ধে তৎপর আছে৷
পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জেলার প্রায় সর্বত্রই মেলে ইয়াবা বড়ি৷ এ ছাড়া ফেনসিডিল, গাঁজা, বাংলা মদও পাওয়া যায় খুব সহজে৷ রেল, নৌ ও সড়কপথে আখাউড়া, ভৈরব, কুমিল্লা, টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক আসে নরসিংদীতে৷ জেলার যোগাযোগব্যবস্থা ভালো হওয়ায় সব জায়গায় মাদক ছড়িয়ে পড়ে অনায়সে৷ তা ছাড়া সরকারি দলের অনেক নেতা-কর্মী, এমনকি রেল ও থানা-পুলিশের কিছু কর্মকর্তাও মাদক পাচারে জড়িত৷ এর মধ্যে রেলওয়ের ভৈরব থানার একজন কর্মকর্তা, যিনি আগে আখাউড়ায় ছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে রেলের মাধ্যমে মাদক পাচারের অভিযোগ আছে৷ তাঁর এক ধর্মভাই আখাউড়া এলাকার শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী৷ এ ছাড়া মনোহরদী উপজেলায় ক্ষমতাসীন দলের একজন নেতা ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত বলে পুলিশ জানতে পেরেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ ও সাধারণ মানুষের তথ্য অনুযায়ী, সদর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি মাদক মেলে মাধবদী, শহরের রাঙ্গামাটিয়া, বানিয়াছল, ব্রাহ্মন্দী, কাউরিয়াপাড়া, দত্তপাড়া, দাসপাড়া, ঘোড়াদিয়া, হাজীপুর, বৌয়াকুড়, বিলাসদি, ভেলানগর ও চিনিশপুরে৷ পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল শিল্প শহর, খালিশকারটেক, মিয়াপাড়া, চরপাড়া, করতেতৈল, বাঙ্গালপাড়া ও ধলাদিয়া এলাকাগুলো মাদক ব্যবসায়ীদের মূল ঘাঁটি। মনোহরদী উপজেলার চন্দনবাড়ি, গোতাশিয়া, পাঁচকান্দি, চালাকচর, বেলাব সদর, শিবপুর বাসস্ট্যান্ড এবং রায়পুর উপজেলার তুলাতলী ও পলাশতলীতে মেলে মাদক৷
নরসিংদীর আবদুল কাদির মোল্লা সিটি কলেজের অধ্যক্ষ মশিউর রহমান মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, এই জেলার প্রধান সমস্যা মাদক৷ এ সমস্যার সমাধান করা গেলে কিশোর অপরাধ, খুনসহ অনেক অপরাধ এমনিতে কমে আসবে৷’
নরসিংদী মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবু রেজা মেহেদি হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই জেলার যোগাযোগব্যবস্থা খুব ভালো। আর সে কারণেই সব জায়গায় মাদক ছড়িয়ে পড়েছে৷ তবে আমরা মাদক নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছি৷ অভিযানের পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদকপ্রবণ এলাকায় গিয়ে আমরা সাধারণ মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছি৷ জনবহুল এলাকায় আমরা মাদকবিরোধী তথ্যচিত্র দেখাচ্ছি৷’
জেলা পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘নরসিংদীতে আমি নতুন এসেছি৷ শুনেছি, এখানকার একটি বড় সমস্যা মাদক৷ এ সমস্যা সমাধানে সর্বোচ্চ উদ্যোগ নেব৷’