প্রবাসী-আয় বাড়লেও প্রবাসীরা বঞ্চিতই
শরিফুল হাসান
অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে চলতি মাসের শেষ সপ্তায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ১৭ বিলিয়ন ডলার বা এক হাজার সাত শ কোটি ডলারের নতুন মাইলফলক ছুঁয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুতে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রবাসীদের পাঠানো প্রবাসী-আয় বা রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই রিজার্ভ এই উচ্চতায় পৌঁছেছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, বিশ্বে প্রবাসী-আয়ের শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন সপ্তম।
প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, কেবল রেমিট্যান্সেই নয়, জনশক্তি রপ্তানিতেও এই সরকার রেকর্ড ছুঁয়েছে। বিএনপি জোট সরকারের চেয়ে গত পৌনে পাঁচ বছরে ১০ লাখ ৪৩ হাজার ২৪২ জন কর্মী বেশি বিদেশে গেছেন।
তবে এই খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনশক্তি রপ্তানি খাতে অনেক সফলতা থাকলেও সৌদি আরব, কুয়েত, ইরাকের মতো বন্ধ শ্রমবাজার চালু করতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া যাঁরা এত কষ্ট করে অর্থ পাঠাচ্ছেন, সেই প্রবাসীরা এখনো বঞ্চিত। তাঁদের কল্যাণের বিষয়টি অতীতের মতোই এই সরকারের আমলেও অবহেলিত রয়ে গেছে, বরং এখনো পাসপোর্ট করা থেকে শুরু করে বিদেশে যেতে-আসতে বিমানবন্দরে হয়রানি, দূতাবাসে গিয়ে অবহেলা, দুর্ভোগ—এই সমস্যাগুলো রয়েই গেছে।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি জোট সরকারের চেয়ে জনশক্তি রপ্তানি ৭৮ ভাগ এবং প্রবাসী-আয় ২১১ ভাগ বেড়েছে। কেবল তা-ই নয়, এই খাত দালালমুক্ত হয়েছে। সরকারিভাবে এখন মাত্র ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকায় কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন। এই খাতে এত দিন কোনো আইন ছিল না। আমরা বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইন করেছি। সব মিলিয়ে বলা যায়, তিন দশক ধরে এই খাতে যে বিশৃঙ্খলা ছিল, সেগুলো দূর হয়েছে।’
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০৬ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোট ১৩ লাখ ২৮ হাজার ৮২৬ জন কর্মী বিদেশে গিয়েছিলেন। আর ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের ২২ অক্টোবর পর্যন্ত ২৩ লাখ ৭২ হাজার ৬৮ জন কর্মী বিদেশে গেছেন। বিএনপির পাঁচ বছরে প্রবাসী-আয় এসেছে এক হাজার ৮৭৪ কোটি ডলার। আর এই সরকারের সময়ে রেমিট্যান্স এসেছে পাঁচ হাজার ৮৩৯ কোটি ডলার।
এ ছাড়া গত চার বছরে নারী অভিবাসনও বেড়েছে। জোট সরকারের সময়ে যেখানে পাঁচ বছরে ৪৩ হাজার ৮৩৮ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন, সেখানে এই সরকারের সময়ে এক লাখ ৬১ হাজার ৯২১ জন নারী কর্মী বিদেশে গেছেন। নারী কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর আগে এখন ২১ দিনের একটি প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। তবে এত কিছুর পরেও লেবাননসহ মধ্যপ্রাচ্যে নারীরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী বলেন, বিদেশগামীদের সহায়তা করতে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক করা হয়েছে। সরকারিভাবে নাম নিবন্ধনের মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠানোর কারণে দালালপ্রথা বন্ধ হয়েছে। চার বছর পর মালয়েশিয়ায় সরকারিভাবে কর্মী পাঠানো এই সরকারের একটি সাফল্য।
ব্যর্থতা যেখানে: জনশক্তি রপ্তানি খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, কর্মী যাওয়া বাড়লেও বন্ধ থাকা সৌদি আরব, ইরাক, কুয়েত ও লিবিয়ার বাজার চালু করতে পারেনি সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া আরেকটি ব্যর্থতা। এ ছাড়া নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধানের জন্য বর্তমান সরকার পাঁচটি কমিটি করেছিল। কিন্তু গত পাঁচ বছরেও নতুন কোনো বড় শ্রমবাজার খুঁজে পায়নি বাংলাদেশ।
গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড় লাখ প্রবাসীকে ফিরে আসতে হয়েছে। দেশে এসেছে ১১ হাজার প্রবাসীর মরদেহ। সরকার মানবপাচার আইন করলেও অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া এখনো বন্ধ করতে পারেনি। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের দ্বন্দ্ব এ খাতে নতুন সংকট তৈরি করেছে। প্রবাসীদের বিশেষ সুবিধার জন্য ২০০৮ সালে সরকার একটি নীতিমালা করলেও এখনো বাস্তবায়ন করা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অভিবাসন খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা উচ্চ ব্যয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর কয়েকবার এ ব্যয় ‘যৌক্তিক পর্যায়ে’ কমিয়ে আনার আশ্বাস দিলেও এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা করতে পারেনি। তবে মন্ত্রী বলেছেন, মালয়েশিয়ায় এখন ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকায় কর্মী যাচ্ছেন। মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশেও ভবিষ্যতে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় কর্মী যাবেন।
অভিবাসনবিষয়ক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাসনিম সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই সরকারের সময়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অবকাঠামোগত বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। মন্ত্রণালয়ের পরিসর ও জনবল বেড়েছে। এগুলো ভালো। এ ছাড়া ১৯৮২ সালের অধ্যাদেশটি যুগোপযোগী করা, জাতিসংঘ সনদে স্বাক্ষর—এগুলো ভালো উদ্যোগ।’
ব্যর্থতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, ‘মালয়েশিয়ার পদ্ধতি বাদ দিলে এখনো কর্মীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণে। আর প্রবাসীদের কল্যাণ অধিকারের বিষয়টিতে তো আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। বিদেশ ফেরতদের জন্য কিছুই করা হচ্ছে না। কল্যাণ তহবিলের অর্থে দৈনন্দিন কাজ হচ্ছে। এসব সমস্যা সমাধানে অভিবাসন দশক ঘোষণা করা এবং সব উন্নয়ন পরিকল্পনায় অভিবাসন খাতকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।’