শরিফুল হাসান
“আম্মা,দেশের এই রকম অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও, আমি হয়তো যাব শেষ পর্যন্ত। কিন্তু আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রূকুটির সামনে কোনদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?কাজেই আমি যুদ্ধে যেতে চাই।” রুমী। পুরো নাম শাফি ইমাম রুমী।
খুব ভালো ফলাফল করে উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে রুমী সে সময়ের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হন। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। কিন্তু ততোদিনে যে দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে।সময়ের দাবি, দেশের দাবি। রুমী যুদ্ধে যেতে চান।
অনুমতি দিলেন মা জাহানারা ইমাম। দেশের জন্য উৎসর্গ করলেন ছেলেকে। রুমী চলে গেলেন ভারতে। সেক্টর-২ এর অধীনে মেলাঘরে প্রশিক্ষণ নিলেন খালেদ মোশাররফ ও এটিএম হায়দারের অধীনে। প্রশিক্ষণ শেষ করে যোগ দিলেন ক্র্যাক প্লাটুনে।
ক্র্যাক প্লাটুন পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে ঢাকায় একের পর এক গেরিলা আক্রমণ করে মুক্তিযুদ্ধকে অন্যরকম রূপ দেন। রুমী ও তার দলের সদস্যরা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ শেষে ঢাকায় এসে হামলা চালাতেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে।
সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন হামলাসহ ঢাকায় তাদের একের পর গেরিলা অভিযানে পাক বাহিনী তখন অস্থির হয়ে উঠে। প্রতিটি অভিযানে দারুণ সাহসিকতার পরিচয় দেন রূমী। বিশেষ করে ধানমণ্ডি রোডে একটি পাকিস্তানি সেনা জিপ তাদের বহনকারী গাড়ির পিছু নিলে তিনি গাড়ির পেছনের কাচ ভেংগে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করেন।
তাঁর গুলিতে পাকিস্তানি জিপের ড্রাইভার নিহত হয় এবং গাড়ি ল্যাম্পপোস্টে যেয়ে ধাক্কা খায়। এরপর কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা তাঁর গুলিতে মারা যায়।ধানমণ্ডি রোডের অপারেশনের পর রুমী তার সহকর্মীদের মাঝে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ঢাকায় এই অভিযানে গল্প ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর পাকিস্তানি বাহিনী তাকে হন্য হয়ে খুঁজেত থাকে। এদিকে ঢাকায় এসে মায়ের জন্য মন ছটফট করে রূমীর।
কতোদিন মাকে দেখা হয়নি!১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট রুমী মা জাহানারা ইমামকে দেখতে নিজের বাড়িতে যান। কিন্তু দেশি রাজাকার দালালদের সহায়তায় রুমীসহ আলতাফ মাহমুদ, আবুল বারাক, আজাদ ও জুয়েলসহ আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে গ্রেপ্তার করে পাক বাহিনী। রুমীর সাথে তাঁর বাবা শরীফ এবং ভাই জামীকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। জিজ্ঞাসাবাদের স্থানে রুমীকে ভাই ও বাবাসহ একঘরে আনলে রুমী সবাইকে তার যুদ্ধে জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করতে বলেন।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন যে, পাক বাহিনী তার কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সচেতন এবং এর সব দায়-দায়িত্ব তিনি নিজেই নিতে চান।৩০ আগস্টের পর রুমী ও তার সহযোদ্ধা বদী এবং চুল্লুকে আর দেখা যায়নি। ইয়াহিয়া খান ৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দিলে অনেক আত্মীয় তার জন্য আবেদন করতে বলেন। কিন্তু রুমী যে বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ধরা পড়েছে, তাদের কাছেই ক্ষমা চাইতে রুমীর বাবা মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী, দেশপ্রেমিক শরীফ ইমাম রাজি ছিলেন না।
রুমীদের গ্রেপ্তারের খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েছলিনে সেক্টর কমাণ্ডার খালেদ মোশাররফ। পরে জানা যায়, পাক বাহিনী তাকে হত্যা করেছে। তবে শত নির্যাতনেও সহযোদ্ধাদের ব্যাপারে মুখ খোলেনি রুমী। বরং দেশের জন্য নিজের জীবনটা উৎসর্গ করাটাই শ্রেয় মনে করেছেন।রূমীর মা জাহানারা ইমাম রচিত একাত্তরের দিনগুলি বইটি নিশ্চয়ই অনেকে পড়েছেন। এই বইয় রুমী অন্যতম প্রধান চরিত্র।
রূমীর মৃত্যুর পর জাহানারা ইমাম শহীদ জননী উপাধি পান। আজীবন তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য সংগ্রাম করেছেন। যতোবার আমি রুমীর কথা ভাবি আমার চোখ ভিজে আসে। রুমীর মতো বীরেরা ছিলো বলেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই গত কয়েকবছর ধরে এই দিনে রুমির কথা লিখি। আমার কাছে তারুণ্য মানে শাফি ইমাম রুমী যারা দেশের জন্য হাসতে হাসতে মরতেও ভয় পায় না।
ওপর থেকে দোয়া করবেন রূমী ভাই যেন এই দেশে আপনার মতো লাখো রুমী জন্ম নেয় শত সংকটেও যাদের বুকের মধ্যে থাকবে বাংলাদেশ। আজ ২৯ মার্চ বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমীর জন্মদিন। স্বাধীন বাংলাদেশের আজকের সকালে আপনাকে ভালোবাসা জানিয়ে শুরু করছি। স্বাধীনতার এই মার্চ মাসে সব মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদদের স্যালুট। শুভ সকাল রুমী ভাই। শুভ সকাল বাংলাদেশ।