শরিফুল হাসান
লেবাননে গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশি নারীশ্রমিকদের একটা অংশ নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। পোশাকশ্রমিক কিংবা সেবিকা হিসেবে কাজ দেওয়ার কথা বলে নেওয়া হলেও বাস্তবে তাঁদের কাজ করতে হচ্ছে বাসাবাড়িতে। সেখানে তাঁদের অনেকের ওপর চলছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। লেবানন থেকে দেশে ফিরে আসা কয়েকজন নারী প্রথম আলোর কাছে তাঁদের ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন।লেবাননে কর্মরত বেশ কয়েকজন নারীশ্রমিক তাঁদের উদ্ধারের আবেদন জানিয়েছেন। লেবাননে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় তাঁরা কোথাও যোগাযোগ করতে পারছেন না।জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো সূত্রে জানা গেছে, গত সাত মাসে মোট ১১ হাজার ২৭৬ জন নারী বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নারী গেছেন লেবাননে। এ সংখ্যা সাত হাজার ৯৫ জন।কুলসুম নামে এক নারী এ বছরের ৩ মে ইস্ট ওয়েস্ট ট্রেড লিংকার্স নামে একটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে লেবানন যান। তাঁর বাড়ি নওগাঁ জেলা সদরের সুলতানপুর গ্রামে। কুলসুমের ভাই এস এম আক্তারুজ্জামান প্রথম আলোকে জানান, যাওয়ার কিছুদিন পরই কুলসুম মোবাইল ফোনে তাঁকে জানান, সেখানে পৌঁছানোর পর তিন দিন তিনি বিমানবন্দরে অর্ধাহারে পড়ে ছিলেন। এরপর কিছু লোক তাঁকে একটি বাসায় কাজ করানোর কথা বলে নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে কাজ করার পাশাপাশি তাঁর ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন চলছে। আক্তার বলেন, ‘আমার বোন বলেছে এক সপ্তাহের মধ্যে তাঁকে উদ্ধার করতে না পারলে সে আত্মহত্যা করবে। আমরা কোথায় যাব, কী করব, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।’ এ ব্যাপারে জনশক্তি ব্যুরোতে একটি অভিযোগ দায়ের করেছেন বলে তিনি জানান।ইস্ট ওয়েস্ট ট্রেডার্স লিংকার্সের স্বত্বাধিকারী ইমরোজ হায়দারের মোবাইল ফোনে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তাঁর ভাই মোহাম্মদ হাসান ফোন ধরেন। তিনি আরেকটি জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। কুলসুমের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে কোনো নারী ব্যক্তিগতভাবে শ্রমিক হিসেবে বিদেশে যেতে পারেন না। তাই তাঁরা কোনো এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে যান। এ ক্ষেত্রে এজেন্সি সামান্য কিছু টাকা পায়। কুলসুম সেভাবেই ইস্ট ওয়েস্টের মাধ্যমে বিদেশে যান।’ তিনি বলেন, কুলসুম যে সমস্যায় পড়েছেন, সেটি তাঁদের জানানো হয়নি। এমনকি পরিবারের পক্ষ থেকেও তাঁদের কিছু বলা হয়নি। জানালে তাঁরা খোঁজখবর নিয়ে কুলসুমকে উদ্ধারে সাধ্যমতো চেষ্টা করবেন।শাহিনুর নামে ডেমরার আরেক নারীশ্রমিক তিন সপ্তাহ আগে লেবানন যান। সেখান থেকে ফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৭০ হাজার টাকা চুক্তিতে তিনি সেখানে যান। যাওয়ার পর গৃহকর্মীর কাজ করার জন্য তাঁকে একটি বাড়িতে নেওয়া হয়। কথা ছিল, তাঁকে মাসে ১৫ হাজার টাকা দেওয়া হবে। কিন্তু লেবাননে তিনি যে বাড়িতে থাকছেন সেই বাড়ির গৃহকর্তা ও দুই ছেলে তাঁকে নানাভাবে নির্যাতন করেন।মানিকগঞ্জের রিকশাচালক লাল মিয়ার স্ত্রী ডালিয়া ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে লেবানন যান। লাল মিয়া প্রথম আলোকে জানান, দীর্ঘদিন স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। হঠাত্ করে জুলাই মাসে টেলিফোন করে ডালিয়া শারীরিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার কথা তাঁকে জানান এবং সেখান থেকে উদ্ধার করতে বলেন। স্ত্রীকে দেশে ফিরিয়ে আনতে লাল মিয়া পররাষ্ট্র এবং জনশক্তি, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন।একই ধরনের অভিযোগ করে তাঁদের উদ্ধারের অনুরোধ করেছেন ফরিদপুরের নার্গিস বেগমসহ অনেকেই। নাম না প্রকাশ করে কেউ কেউ প্রথম আলোকে তাঁদের ওপর যৌন নিপীড়নের অভিযোগও করেন।লেবাননে নির্যাতিত হয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরতে বাধ্য হয়েছেন আফরিন রানু নামে এক নারী। তাঁর বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। রানু জানান, গত বছর ২১ ডিসেম্বর তিনিসহ ৩০ জন নারী লেবানন যান। এরপর তাঁকে তিন লেবাননি এসে একটি বাসায় নিয়ে যায়। সেখান থেকে ১৫ দিন পর আরেকটি বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। এ সময় তাঁর ওপর নানাভাবে নির্যাতন শুরু হয়। তাদের অনেক কথায় রাজি না হওয়ায় বৈদ্যুতিক শক ও পাথর দিয়েও নির্যাতন করা হতো। এ সময় লেবাননি লোকটা বলত, ‘তোকে টাকা দিয়ে কিনেছি। তিন বছরের আগে দেশে যেতে পারবি না।’ বাধ্য হয়ে মোবাইল ফোনে তিনি বিষয়টি বাংলাদেশে তাঁর মাকে জানান। এরপর তাঁর মা বিষয়টি আইন ও শালিস কেন্দ্রকে জানান। তাদের সহায়তায় এ বছরের ২৪ মে তিনি দেশে ফিরে আসেন। রানুর যে কাজের অনুমতিপত্র, তাতে লেখা, তাঁকে গৃহকর্মের জন্য গাদা হায়দার নামে এক মহিলা স্পনসর করেছেন।প্রবাসী শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হেদায়েত উল্লাহ বলেন, স্বামীর অত্যাচার কিংবা সংসারের অন্যদের অবহেলায় বাংলাদেশের নারীরা বেশি টাকা রোজগারের স্বপ্নে বিদেশে যেতে আগ্রহী হন। কিন্তু এই নারীদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত। ফলে সহজেই তাঁরা দালালের খপ্পরে পড়েন। আর তাই কাজের কথা বলে তাঁদের বিদেশে পাঠানো হলেও তাঁরা সেখানে গিয়ে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে লেবাননে যাওয়া নারীরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার।জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বুর্যোতে একটি নারী অভিবাসন তথ্যকেন্দ্র রয়েছে। সেই কেন্দ্রের কর্মকর্তা মাহমুদা আক্তার বলেন, যেসব নারীশ্রমিক বিদেশে যেতে চান, তাঁদের বেশির ভাগই ভালো করে পড়ালেখা জানেন না। এই কেন্দ্র থেকে তাঁদের সাধ্যমতো সহায়তা দেওয়া হয়, যেন তাঁরা বিদেশ যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র পরীক্ষা করে, নিয়োগকারী দেশের ভাষা কিছুটা জেনে সেখানে যান। কিন্তু বিদেশে গিয়ে বিপদে পড়লে তাঁদের ওই দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগাযোগ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁদের কিছুই করার থাকে না।বাংলাদেশ জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি গোলাম মুস্তফা বলেন, এখন আট-দশটা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে মেয়েরা। বিষয়টি উন্মুক্ত করে দিলে এতে স্বচ্ছতা আসত। তিনি বলেন, বিদেশে মেয়েরা যদি পোশাক কারখানা বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে যান, তাহলে ততটা সমস্যা হয় না। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে গেলে সমস্যা হতে পারে।জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর পরিচালক (ইমিগ্রেশন অ্যান্ড প্রটোকল) আবদুর রশিদ বলেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সাত হাজার ৯৫ জন নারী লেবানন গেছেন। এঁদের মধ্যে যদি কেউ বিপদে পড়েন এবং সুনির্দিষ্টভাবে তাঁরা জানতে পারেন, তাহলে যে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বিদেশ গেছেন সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তাঁকে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে।