কর্মজীবী নারী ও ছাত্রীরা ভোগান্তির আশঙ্কায়
শরিফুল হাসান

বাংলামোটর থেকে বাসে চড়ে প্রতিদিন কর্মস্থল শ্যামলীর একটি সরকারি হাসপাতালে যাতায়াত করেন চিকিৎসক হেনা কামাল। ‘সিটিং সার্ভিস’ বাস বন্ধ করায় গতকাল রোববার ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আগে মহাখালীর জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউটে যখন যেতাম, তখন ৬ নম্বর লোকাল বাসে যেতে হতো। গত কয়েক মাসে সেই অভিজ্ঞতা দূর হয়েছে সিটিং বাসে চড়ে। এখন আবার লোকাল বাসে চড়তে হবে ভেবে হতাশ লাগছে।’
কেবল হেনা কামাল নন, কর্মজীবী অনেক নারী এবং ছাত্রী সিটিং বাস বন্ধের সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এই ক্ষোভের কারণ লোকাল বাসকেন্দ্রিক নানা বিড়ম্বনা ও ভোগান্তি। তাঁরা বলছেন, ঢাকার মেয়েদের যাঁদের ব্যক্তিগত গাড়ি নেই, তাঁদের জন্য সিটিং সার্ভিস বাস একটা অবলম্বন ছিল। তাঁরা বাসে উঠে আসন পেতেন। ওঠা-নামার সময় ভোগান্তি ছিল না। টাকা বেশি লাগলেও এতে লোকাল বাসে ধাক্কাধাক্কি আর বাজে পরিবেশ থেকে মোটামুটি রেহাই পাওয়া যেত। কিন্তু এখন লোকাল বাসে ভোগান্তির ভয়ে তাঁরা আতঙ্কিত। বাস লোকাল হলেও ভাড়া কমেনি।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল থেকে রাজধানীতে সিটিং সার্ভিস বন্ধে অভিযানে নেমেছে বিআরটিএ। ফলে গতকাল থেকে সিটিং বাস চলাচল বন্ধ হয়েছে। শাহবাগ, ফার্মগেট, আগারগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গায় নারীদের বাসে উঠতে ‘যুদ্ধ’ করতে হয়েছে। বাসে ছিল ভিড়। অন্তত ২০ জন নারী বাসে ওঠা নিয়ে তাঁদের সমস্যার কথা জানিয়েছেন প্রথম আলোকে।
মালিবাগ থেকে বাসে কর্মস্থল সাভারে যাতায়াত করেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জান্নাতুল মাহিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধাক্কাধাক্কি থেকে বাঁচার জন্য সিটিং সার্ভিসে উঠেছেন। ভাড়া একটু বেশি হলেও স্বস্তি ছিল। কিন্তু এখন তো আমাদের সমস্যা হয়ে গেল। মেয়েদের কথা ভেবে হলেও কিছু সিটিং বাস রাখা উচিত।’
বেসরকারি একটি সংস্থার পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম বলেন, ‘সিটিং বাস উঠে গেলে আমরা মেয়েরা তো বাসে উঠতে পারব না। আর উঠতে গেলে যে যুদ্ধ করতে হবে, সেটা কি সবার পক্ষে সম্ভব?’ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, ‘আমি লোকাল বাসে চড়ে কিছুদিন যাতায়াত করেছি। নারী সিট পর্যন্ত যেতে কিংবা বাসে জায়গা না পেলে এতসব অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যে নিজেকে আর মানুষই মনে হয় না। এটা একটা মানসিক যন্ত্রণা হয়ে গিয়েছিল। ঢাকায় বাসে চড়া সব মেয়েকে সেই অভিজ্ঞতা যাঁরা দিতে চাইছেন, তাঁদের প্রতি ক্ষোভ জানাচ্ছি।’
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আরহামা সুরমা বলেন, সিটিং বাসে তুলনামূলকভাবে কম লোক ওঠে। ফলে সমস্যাও কম হয়। এখন যদি আবার সেখানে গাদাগাদি করে উঠতে হয়, তাহলে ছাত্রী ও চাকরিজীবী মেয়েদের কী যে ভোগান্তি হবে এটা পুরুষদের কখনো বোঝানো যাবে না।
সিটিং বাস তুলে দিয়ে মেয়েদের জন্য ভয়াবহ একটি সংকট তৈরি করা হলো বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি কলেজের শিক্ষক মিলি ফাতেমা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে চাকরির কোচিং করা মেয়ে তায়বা বিনতে শাহিন বলেন, ‘আমি প্রতিদিন মিরপুর-১ থেকে সিটিং বাসে নীলক্ষেত নামি। এখন লোকাল বাসে চড়তে হবে ভেবে দম বন্ধ হয়ে আসছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন, ‘সব যদি লোকাল বাস হয় নারী, শিশু, বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষদের কী হবে? গর্ভবতী মেয়েদের কী হবে? এই বিষয়গুলো রাষ্ট্রের ভাবা দরকার।’
গতকাল আসাদগেট, আগারগাঁও (আইডিবি ভবনের সামনে), শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পাশে, রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সামনে ও যাত্রাবাড়ীর চাংপাই রেস্তোরাঁর সামনে সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত ‘সিটিং সার্ভিস’ বন্ধে অভিযান চালান।
ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, কিছু সমস্যা তো থাকবেই। দীর্ঘদিনের অনিয়মগুলো তো এক দিনে বন্ধ হবে না। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) নাজমুল আহসান মজুমদার বলেন, ‘মেয়েদের বিষয়টা আমরাও ভেবেছি। রোববার প্রথম দিনের অভিযানে আমাদের ম্যাজিস্ট্রেটরাও বিষয়গুলো খেয়াল করেছেন। অনেক নারী আসন ছেলেরা দখল করে থাকেন। আবার পুরুষদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে মেয়েরা উঠতেও পারেন না। সিটিং বাস লোকাল হলে এই সমস্যাটাই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দেবে, সেটা আমরাও বুঝেছি। তবে নারীদের জন্য আমাদের বিআরটিসির ১৮টা বাস আছে। সেগুলোতে চড়তে পারেন নারীরা। পাশাপাশি সার্বিকভাবে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনলে হয়তো সমস্যাগুলোর সমাধান হবে। এ ক্ষেত্রে পুরুষদের ইতিবাচক মানসিকতা জরুরি।’