মিল্ক ভিটাকে চুষে খাচ্ছে ‘দুর্নীতিবাজেরা’

Spread the love

শরিফুল হাসান


দুর্নীতির দায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চাকরি যাওয়া ৬১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে পুনর্বহাল করা হয়েছে। আর পুনর্বহালের সময় এঁদের ‘জোট আমলের বঞ্চিত’ উল্লেখ করে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গেও প্রতারণা করা হয়েছে। আবার চাকরি ছাড়ার সময় অবসর-সুবিধা হিসেবে নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার শর্তে চাকরিতে যোগদান করলেও ১৪ জন কর্মকর্তা এক কোটি ২০ লাখ ১৮ হাজার ৬৫১ টাকা ফেরত দেননি। উল্টো এঁরা চাকরিতে না থাকা সময়ের বেতন-ভাতাও পাচ্ছেন। এসব ঘটনা ঘটেছে মিল্ক ভিটা নামে পরিচিত বাংলাদেশ দুগ্ধ উত্পাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডে।একইভাবে প্রতিষ্ঠানের চাকরিচ্যুত ও অপ্রয়োজনীয় আরও চার শ কর্মচারীকে আবার নিয়োগের চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যে ৭৫ জনকে অবৈধভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও দেওয়া হয়েছে। বিপুল অঙ্কের ঘুষ-বাণিজ্যসহ এ সবকিছুর পেছনে আছেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমান। তাঁর ও ব্যবস্থাপনা কমিটির অবৈধ ক্ষমতার চর্চায় অচল হতে চলেছে মিল্ক ভিটা। দুশ্চিন্তায় পড়েছেন সমবায় অধিদপ্তরের অধীন জাতীয় সমবায় প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার সঙ্গে জড়িত ১৫ লাখ সমবায়ী।স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের বরাবরে দেওয়া মিল্ক ভিটার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের উদ্যোগ না নিয়ে ব্যবস্থাপনা কমিটি অবৈধ নিয়োগ, কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। এরই মধ্যে এই কমিটি চাকরিচ্যুত ১৫ জন কর্মকর্তা ও ৪৬ কর্মচারীকে পুনর্বহাল করেছে। এঁদের কাছ থেকে ৭৫ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়া হয়েছে। লিখিত অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, দুর্নীতির এই প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমান। তাঁকে সহযোগিতা করেছেন দুর্নীতির দায়ে চাকরি চলে যাওয়ার পর ফিরে আসা ব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মাহবুবুর রহমান। এঁরা মিল্ক ভিটাকে প্রায় পঙ্গু করে ফেলছেন বলে দাবি করেছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।জোট সরকারের সময়ে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় মিল্ক ভিটা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মিল্ক ভিটার একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি করা হয়। ওই কমিটি বেশ কয়েকটি কমিটি করে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে। দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়ায় তখন ১৫ জন কর্মকর্তা ও ৭৫ জন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়।বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের ১১ মার্চ আগের কমিটি বাতিল করে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা কমিটি করে। এই কমিটির সভাপতি ওহেদুল্লাহ্ মোল্লা ও শফিকুর রহমান সহসভাপতি। বর্তমানে মিল্ক ভিটার অনিয়ম-দুর্নীতির যত অভিযোগ উঠছে, সব কটির সঙ্গে জড়িত হিসেবে শফিকুর রহমানের নাম আসছে। তিনি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসাধারণ সম্পাদক। মিল্ক ভিটায় তিনি সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানকের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজেও উচ্চকণ্ঠে এ দাবি করে কর্মকর্তাদের তটস্থ রাখেন।দুর্নীতিবাজদের পুনর্বহাল: মিল্ক ভিটার ১১টি কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অগ্নি ও নৌ-বিমার প্রিমিয়াম বাবদ ১৩ লাখ ৯৪ হাজার ৯৪৬ টাকার আর্থিক অনিয়মের তদন্ত হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে। কমিটির কাছে কারখানার সে সময়ের ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক এম এ বারিক লিখিতভাবে তাঁর অপরাধ স্বীকার করেন। কারখানার অতিরিক্ত মহাব্যবস্থাপক (অর্থ ও হিসাব) ইদ্রিস আহমেদ ও মঈনুল হক চৌধুরী এই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে তদন্তে প্রমাণিত হয়।২০০৮ সালের ৮ জুন তখনকার ব্যবস্থাপনা কমিটি এই তিনজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে। তবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে সব দেনাপাওনা দিয়ে ২০০৮ সালের ১ জুন থেকে তাঁদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। দেনাপাওনা বুঝে নিয়ে তাঁরাও চাকরি ছেড়ে চলে যান।কিন্তু গত বছরের ৫ এপ্রিল এঁদের স্বপদে পুনর্বহাল করা হয়। পরদিনই তাঁরা কাজে যোগ দেন। গত ৭ ফেব্রুয়ারি বাকিরকে মিল্ক ভিটার মহাব্যবস্থাপক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়। সমবায় অধিদপ্তরের চাকরিবিধি ও নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী, একান্ত প্রয়োজনে কারিগরি পদ ছাড়া অবসর গ্রহণকারী কাউকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যায় না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ জমা দিয়ে ১২ জানুয়ারি বারিক তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহালের আবেদন করেন। তাঁর আবেদনে সুপারিশ করেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ ও বিধি ভেঙে নিয়োগের বিষয়টি সমবায়মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের নজরে আনা হলে ১৩ ফেব্রুয়ারি বাকিরের নিয়োগ বাতিল করা হয়।এই তিনজনসহ মোট ২৩ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছিল কমিটি। তবে তদন্ত কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে এঁদের মধ্যে নয়জনের অপরাধ কম হওয়ায় তাঁদের সতর্ক করার সিদ্ধান্ত হয়। বাকিদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু এঁদের মধ্যে দুজন আগেই অবসরে চলে যান। বাকি ১২ জনকে ২০০৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়।অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা হলেন উপমহাব্যবস্থাপক (মান নিয়ন্ত্রণ) শামীমা বেগম, উপমহাব্যবস্থাপক (টেকনিক্যাল) আবদুল মালেক, উপব্যবস্থাপক (সমিতি) আবদুল খালেক, উপমহাব্যবস্থাপক (সমিতি) জয়গোপাল দাস, ব্যবস্থাপক (কেন্দ্রীয় গুদাম) আবদুল মান্নান, ব্যবস্থাপক (বিপণন) মিজানুর রহমান তালুকদার, ব্যবস্থাপক (সাতক্ষীরা দুগ্ধ কারখানা) মাহবুবুর রহমান, উপব্যবস্থাপক (বিপণন) আবুল কালাম আজাদ, উপব্যবস্থাপক (বিডিপি) মনোয়ারা বেগম, উপব্যবস্থাপক (আইন ও এস্টেট) সফিকুল ইসলাম চৌধুরী, উপব্যবস্থাপক শরীফুল ইসলাম তালুকদার ও উপসহকারী ব্যবস্থাপক (ডিডিপি) মতিউর রহমান।কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, এই কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে হুমকির মুখে পড়েছে মিল্ক ভিটার অস্তিত্ব। তাঁরা চাকরিতে থাকলে প্রতিষ্ঠানের আরও ক্ষতি হবে।চাকরি ফিরিয়ে দেয় নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি: ২০০৯ সালের ১২ মার্চ নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রথম বৈঠকেই ওই ১২ জন কর্মকর্তার বিষয়ে আলোচনা হয়। ১৮ মার্চ কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি হয়। ২৪ মার্চ কমিটি ওই ১২ জন কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহালের সুপারিশ করে। তবে এই সুপারিশে ব্যবস্থাপনা কমিটির নয় সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন সন্ধ্যা রানী বালা ও শাহাদাত হোসেন সই করেন। এই দুজন সমবায়ী সদস্য।পরদিন ২৫ মার্চ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ওহেদুল্লাহ্ মোল্লা ১২ কর্মকর্তাকে স্বপদে বহাল করতে কারখানার ভারপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপককে নির্দেশ দেন। একই দিন ওহেদুল্লাহ্ মোল্লার স্বাক্ষরিত আরেক আদেশে জানানো হয়, ১২ কর্মকর্তাকে স্বপদে পুনর্বহাল করা হলো। তিন দিনের মাথায় ওই কর্মকর্তারা কাজে যোগ দেন।কিন্তু এর আগেই ওই বছরের ১৬ ও ১৭ মার্চ পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটিকে চিঠি দিয়ে জানায়, ১৫ জনের বাধ্যতামূলক অবসরের আগের আদেশটি বাতিল করা হলো।চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি এক আদেশে ১২ জন কর্মকর্তার মধ্যে জয়গোপাল দাসকে কারখানার প্রধান কার্যালয়ের উপমহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) ও মনোয়ারা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপক (প্রশাসন ও মানবসম্পদ) পদে বদলি করা হয়। মনোয়ারা বেগমের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা, জয়গোপাল দাসের বিরুদ্ধে তেল বিক্রির মাধ্যমে অর্ধকোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছিল তদন্ত কমিটি।মাহবুবুর রহমানের দুর্নীতি: ওই ১২ জন কর্মকর্তার একজন কারখানার বর্তমান ব্যবস্থাপক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মাহবুবুর রহমান। তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়া ও অতিরিক্ত বিলের মাধ্যমে কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জোট সরকারের মন্ত্রীদের খুশি করার জন্য তিনি মৌলভীবাজার জেলায় তিন হাজার ২০০ বর্গফুট জায়গার ওপর পাকা ইমারত করে একটি দুগ্ধ কারখানা স্থাপন করেন। আরেক মন্ত্রীকে খুশি করার জন্য ১০১ শতাংশ জমি ক্রয় করে ২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নরসিংদীর শিবপুরে দুগ্ধ কারখানা স্থাপন করেন। জোট সরকারের আরও চারজন মন্ত্রীর বাড়ির পাশে অপ্রয়োজনীয় দুগ্ধ কারখানা স্থাপন করা হয় তাঁর উদ্যোগে ও তত্পরতায়।তদন্ত কমিটি মাহবুবুর রহমানের বিরুদ্ধে ভুয়া ও অতিরিক্ত বিল তোলা, কারিগরি কমিটির সদস্য না হয়েও যন্ত্রাংশ পরিদর্শনের নামে বিভিন্ন দেশ সফরের মতো অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ পায়।তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, মাহবুবুর রহমান জোট সরকারের আমলে কোনো সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই কনডেন্সড মিল্ক প্লান্ট, ইউএইচটি প্লান্ট (বিডিপি, ডিডিপি), ক্যান মেকিং প্লান্ট, ওয়াটার বোটলিং প্লান্ট প্রকল্প স্থাপন করেন। রাজনৈতিক বিবেচনায় স্থাপিত সব কারখানাই বর্তমানে বন্ধ।বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি মাহবুবুর রহমানকে চাকরিতে ফিরিয়ে এনে পরিকল্পনা ও উন্নয়নের পাশাপাশি অর্থ বিভাগের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে স্ত্রীর বিজ্ঞাপনী সংস্থার মাধ্যমে মিল্ক ভিটার বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা তুলে নেওয়ার অভিযোগ জমা পড়েছে মন্ত্রীর কাছে। দুর্নীতি করে চাকরিহারা, প্রতারণা করে পুনর্বহাল: চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরি গেছে দাবি করে মিল্ক ভিটার তিনজন কর্মচারী কর্তৃপক্ষের কাছে চাকরি ফেরতের আবেদন করেন। কিন্তু ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমান ওই তিনজনের সঙ্গে আরও ৫০ জনকে যুক্ত করে একটি ‘বঞ্চিত তালিকা’ করেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে মাত্র দুজন জোট সরকারের সময়ে চাকরি হারিয়েছেন। বাকি সবার চাকরি গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি অভিযোগে, তদন্ত কমিটির সুপারিশে। কিন্তু বঞ্চিত দেখিয়ে গত বছরের ১ জুন পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় সচিবের কাছে এঁদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার সুপারিশ করা হয়। ৫৩ জন কর্মচারীর চাকরিতে পুনর্বহালের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে গত বছরের ১৬ জুলাই একটি কমিটি হয় এবং কমিটির আহ্বায়ক হন শফিকুর রহমান নিজেই। কমিটি ১০ দিন পর প্রতিবেদন দেয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০০৮ সালের ৬ জুন প্রতিষ্ঠানের ৭৪ জন কর্মচারীকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আবার এঁদের ৪৬ জনকে ‘জোট আমলের বঞ্চিত’ দেখিয়ে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়।১৪ কর্মকর্তার কাছে পাওনা এক কোটি ২০ লাখ: প্রশাসনিক অনুমোদন ছাড়াই এই কর্মকর্তাদের অবসরকালীন সময়ের বেতন-ভাতাদিও দেওয়া হয়েছে। আর অর্থ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মাহবুবুর রহমান নিয়ম ভেঙে তিনজন কর্মকর্তার নয় মাসের বেতন-বোনাস বাবদ প্রায় ২০ লাখ টাকা দেওয়ার প্রক্রিয়া করছেন বলে প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা গেছে।কিন্তু যোগদানকারীরা মিল্ক ভিটার পাওনা এক কোটি ২০ লাখ ১৮ হাজার ৬৫১ টাকা তাঁরা পরিশোধ করছেন না। পুনরায় যোগ দেওয়ার সময় তাঁদের এই টাকা দেওয়ার কথা ছিল।চার শ কর্মচারীর চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা: জোট সরকারের আমলে অবৈধভাবে ছয় শ কর্মচারীকে টাকার বিনিময়ে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ৪৭৩ জনকে বাদ দেওয়া হয়। এঁদের মধ্যে গত এক বছরে ৪২ জনকে চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়। বাকিদেরও চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলে ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি এক লাখ টাকা করে নিয়েছেন বলে মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। এই কর্মচারীদের একটি অংশ গত সোমবার শাহজাদপুরে মিল্ক ভিটার উপমহাব্যবস্থাপকের কার্যালয়ে গিয়ে তাঁকে লাঞ্ছিত করে। শফিকুর রহমানের ইন্ধনে এটা হয়েছে বলে কর্মকর্তাদের অভিযোগ। প্রতিবাদে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালন করেন।ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতি শফিকুর রহমান নিজের স্বাক্ষরে এ পর্যন্ত ৭৫ জন শ্রমিককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন বলেও জানা গেছে। প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা মহাব্যবস্থাপকের। কিন্তু এদের কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেন সহসভাপতি শফিকুর রহমান।সহসভাপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ: মিল্ক ভিটার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নামে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে সম্প্রতি তথ্যপ্রমাণসহ নানা অভিযোগ করা হয়েছে। এতে সহসভাপতির বিরুদ্ধে দরপত্রে অনিয়ম, বদলি ও নিয়োগ-বাণিজ্যসহ নানা অভিযোগ আনা হয়। অভিযোগে বলা হয়, মেসার্স সিক্রেট অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি ফার্মকে দুধের কার্টন কেনার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু নিম্নমানের এই কার্টনে দুধ নিতে আপত্তি জানায় পরিবেশকেরা।কারখানার উত্পাদন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্দেশে গত রমজান মাসে ও ঈদ উপলক্ষে বাজারে প্রতিদিন তিন থেকে চার লাখ লিটার তরল দুধ ছাড়া হয়েছিল। এর মধ্যে এক লিটারের প্যাকেটের ১০০ গ্রাম এবং আধা লিটারের প্যাকেটে ৫০ গ্রাম দুধ কম দেওয়া হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন ২০ হাজার লিটার দুধ চুরি করা হয়েছে।জানা গেছে, সহসভাপতি শফিকুর রহমান ও প্রতিষ্ঠানের দুই পরিচালক টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রামে সমিতি থাকা সত্ত্বেও নতুন করে সমিতি তৈরি করছেন। নিয়ম অনুযায়ী এক গ্রামে একটি সমিতি থাকার কথা। কিন্তু পাবনা-সিরাজগঞ্জে অনেকটা ঘরে ঘরে সমিতি করা হচ্ছে।মন্ত্রণালয়ে করা অভিযোগে বলা হয়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটির সময়ে গাজীপুরে দুগ্ধ বিতরণকারী সমিতির কাছে ২৯ লাখ টাকা, মিরপুর সমিতির কাছে তিন কোটি ৫০ লাখ টাকা ও সূত্রাপুর সমিতির কাছে প্রায় এক কোটি ৫০ লাখ টাকা বকেয়া পড়ে আছে। ব্যবস্থাপনা কমিটি এই টাকা না তুলে তা শেয়ারবাজারে খাটাচ্ছে।কাগজপত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, শফিকুর রহমান অক্টোবর ২০০৯ থেকে এ বছরের ১০ জানুয়ারি পর্যন্ত নিয়মবহির্ভূতভাবে জ্বালানি তেল বাবদ এক লাখ ৪৮ হাজার ৬৩০ টাকা ও মেরামত বাবদ এক লাখ ৩৮ হাজার ১০০ টাকা নিয়েছেন মিল্ক ভিটা থেকে; আর সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহার বাবদ নিয়েছেন চার লাখ ১৫ হাজার টাকা। ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানের মহাব্যবস্থাপকের স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, আইন অনুযায়ী সহসভাপতির সার্বক্ষণিক গাড়ি ব্যবহারের সুযোগ নেই। তবে এখনো শফিকুর রহমান জিপ (ঢাকা-মেট্রো-১১-৫০৩১) গাড়িটি সার্বক্ষণিক ব্যবহার করছেন।মন্ত্রণালয়ে দেওয়া অভিযোগে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানের দরকার না থাকা সত্ত্বেও সহসভাপতির আগ্রহে দ্রুততার সঙ্গে প্রায় আড়াই কোটি টাকা দিয়ে একটি লিকুইড মিল্ক ফিলিং মেশিন এবং এক কোটি ৩৪ লাখ টাকা দিয়ে কনডেন্সড মিল্কের ক্যান ওয়াশিং মেশিন কেনার প্রক্রিয়া চলছে। অথচ বর্তমানে ১৩টি ফিলিং মেশিন আছে; এর মধ্যে মাত্র পাঁঁচটি ব্যবহূত হচ্ছে, আর কনডেন্সড মিল্ক উত্পাদন সম্পূর্ণ বন্ধ আছে।সহসভাপতি শফিকুর রহমান তাঁর পছন্দের কয়েকজন কর্মকর্তার সহায়তায় কয়েক ধাপে প্রতি লিটার দুধের পরিবহন খরচ ৪০ পয়সা বাড়িয়েছেন। এতে বছরে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি হচ্ছে তিন কোটি ২০ লাখ টাকা। বক্তব্য: এসব অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে সহসভাপতি শফিকুর রহমান বলেন, বর্তমান মহাব্যবস্থাপকের কারণে ব্যবস্থাপনা কমিটি কাজ করতে পারছে না। তিনি কোনো কথা শোনেন না। নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি ও অবৈধ নিয়োগের বিষয়ে শফিকুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা ও সরকারের সব মহলের গোচরেই নিয়োগ হচ্ছে। ঘুষ-বাণিজ্যের অভিযোগ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য, ‘এগুলো আমার বিরুদ্ধে কর্মকর্তাদের ষড়যন্ত্র। এমনকি তারা আমার গাড়িটাও কেড়ে নিতে চাইছে।’ প্রতিমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে মিল্ক ভিটাকে তটস্থ করে রাখার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আরও তো অনেকে আছেন, কিন্তু প্রতিমন্ত্রী তো আমাকে পছন্দ করেন। তিনি মিল্ক ভিটার সব বিষয়ে আমার কাছে জানতে চান। মঙ্গলবারও তাঁর সঙ্গে চার ঘণ্টা বৈঠক হয়েছে।’নিজের স্বাক্ষরে ৭৫ জনকে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে শফিকুর রহমানের দাবি, নিয়ম মেনেই তিনি সব করেছেন। অতীতে যখন ব্যবস্থাপনা কমিটি ২৫৬ জনকে পদোন্নতি দিয়েছিল, তখন তো কেউ কিছু বলেনি। তিনি বর্তমান মহাব্যবস্থাপকের প্রতি বিষোদ্গার করে বলেন, এরা প্রতিষ্ঠানটি ধ্বংস করবে।কারখানার মহাব্যবস্থাপক নাসিম আহমেদ বলেন, ব্যবস্থাপনা কমিটির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। কিন্তু জোট সরকারের আমল থেকে তারা ক্ষমতার চর্চা করে আসছে। এ কারণে মিল্ক ভিটায় বিশৃঙ্খলা ও অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। অন্তর্বর্তী কমিটির মূল কাজ হলো নির্বাচন।ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান ওহেদুল্লাহ্ মোল্লা বলেন, নানা জটিলতার কারণে এত দিন নির্বাচন দেওয়া যায়নি। কিন্তু এখন সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। খুব শিগগির নির্বাচন দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, এটি সত্যি, ব্যবস্থাপনা কমিটির নির্বাহী ক্ষমতা নেই, কমিটি ক্ষমতাও দেখাচ্ছে না।অভিযোগগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, মিল্ক ভিটা সমবায়ীদের প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রের সম্পদ। একে বাঁচাতে হবে। এ কারণেই নিয়োগ-পদোন্নতি-অচলাবস্থাসহ সব সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে। ব্যবস্থাপনা কমিটির সহসভাপতির বিষয়ে তিনি বলেন, কে কার ঘনিষ্ঠ, তা বিষয় নয়। প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ দেখতে হবে। ব্যবস্থাপনা কমিটির নিয়োগ-পদোন্নতিসহ অন্যান্য বিষয়ে জড়িয়ে পড়া সম্পর্কে তিনি বলেন, খুব শিগগির নির্বাচন করে নতুন কমিটির কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published.