মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

Spread the love

শরিফুল হাসান

বাংলাদেশ থেকে ১৫ লাখ কর্মী যাবে এমন কথা বলে ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা সই করে মালয়েশিয়া। আমি সেদিন রাতে সময় টিভিতে বলেছিলাম এই সমঝোতা ব্যর্থ হবে। প্রথম আলোতেও লিখেছিলাম। আসলেই তাই হয়েছিল। সমঝোতা স্বাক্ষরের ১২ ঘণ্টার মধ্যেই দেশটি জানায়, এই মুহূর্তে তারা কোনো কর্মী নেবে না।না আমি কোন জ্যোতিষি নই, গত দুই দশকে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার নিয়ে এতো রিপোর্ট আর গবেষণা করেছি যে আমার বলা প্রায় প্রতিটা পর্যবেক্ষণ সত্য হয়েছে।

একইভাবে মালয়েশিয়ার সাবেক মানবসম্পদ মন্ত্রী সারাভান যখন সিন্ডিকেটের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়েছে আমি তখন বলেছি তিনি সিন্ডিকেট চান টাকা আয়ের জন্য। কারণ তিনি জানেন মালয়েশিয়ার পরবর্তী নির্বাচনে যে সরকার হবে সেখানে তিনি আর মন্ত্রী থাকবেন না। দেখেন সারাভান আজ মন্ত্রী নেই। কথাগুলো আজ ফের বলছি এই কারণে যে, মালয়েশিয়ার নতুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুতিন বিন ইসমাইল এখন ঢাকায়।

বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্নয়ন এবং সম্প্রসারণ বিষয়ে আজ প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদে এমপির সাথে তাঁর বৈঠক হয়েছে। আমি এই বৈঠককে ইতিবাচক হিসেবে দেখছি। এই বৈঠকের মধ্য নিয়ে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার দুর্নীতি ও সিন্ডিকেটমুক্ত হোক এমন আশাও করছি। প্রায় চার বছর বন্ধ থাকার পর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার চালু হয়েছিল। আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে সিন্ডিকেটের কারণে ২০১৮ সালে শ্রমবাজার বন্ধ হয়েছিল এবার অন্তত সেটি হবে না।

কিন্তু আমরা দেখলাম মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রী এম সারাভন বিপুল অংকের অর্থের বিনিময়ে একই সিন্ডিকেটকে দিয়ে কর্মী নিতে চাইছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীকে চিঠি দিয়ে জানান, ২৫ জনের একটি সিন্ডিকেট কর্মী পাঠাবে। প্রকাশ্যে লেখালেখি করে, গণমাধ্যমে কথা বলে সব জায়গাতেই আমরা কিছু মানুষ এই সিন্ডিকেটের বিরোধিতা করেছি।

এমনকি বাংলাদেশের প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রীও চিঠি দিয়ে সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। আমি বলেছিলাম এটি একটি দারুণ সিদ্ধান্ত। এ বছরের জুলাই মাসে আমি ডেইলি স্টারে এ নিয়ে দীর্ঘ একটা কলাম লিখি (https://www.thedailystar.net/…/labour-recruitment…)তাতে বলি, মালয়েশিয়ার বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে কোনভাবেই সিন্ডিকেটে যাওয়া উচিত না বাংলাদেশের। আর সিন্ডিকেট দেশের কল্যাণ আনবে না। কিন্তু কে শোনে আমাদের কথা! মালয়েশিয়ার অনড় অবস্থানের কারণে সিন্ডিকেটের জয় হয়। একেজন কর্মীর মালয়েশিয়া যেতে খরচ পড়ে সাড়ে তিন থেকে চার লাখ টাকা। প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ছিল না, ছিল ব্যাপক অনিয়ম।

যে শ্রমবাজোরে কয়েক লাখ বাংলাদেশি কর্মী যেতে পারতো সেই বাজারের সুবিধা নেয় নেপাল। তবে শেষ অব্দি নভেম্বরের নির্বাচনে আনোয়ার ইব্রাহিমের নেতৃত্বে যে সরকার গঠিত হয় তারা ক্ষমতায় আসার পর সারাভান বাদ পড়েন। শুরু হয় নতুন মেরুকরণ। এরই ধারাবাহিকতায় নতুন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আজ ঢাকায় আসেন। দুই মন্ত্রী ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন, বাংলাদেশের হাইকমিশনার মোঃ গোলাম সারওয়ার, মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হাজনাহ মোঃ হাসিম, মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল (পলিসি) দাতুক ফাউজি বিন মোহাম্মদ ইসা, মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি জেনারেল দাতুক মোহাম্মদ খায়ের রাজমান মোহাম্মদ আনুয়ার, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)’র মহাপরিচালক মোঃ শহীদুল আলম এনডিসি, মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক দাতো খাইরুল জাইমি বিন দাউদ সহ মালয়েশিয়া প্রতিনিধিদলের অন্যান্য সদস্যগণ এবং মন্ত্রণালয় ও দপ্তর সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন।

আজকে দুই দেশের মন্ত্রীরা মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের শ্রমবাজার উন্নয়ন, কর্মীদের সামগ্রিক সুরক্ষা এবং দায়িত্ব, তাদের কর্তব্য ও অধিকার নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অভিবাসন ব্যয় কমিয়ে আনার কথা বলেছেন। কম খরচে, সহজে এবং দ্রুত কীভাবে বাংলাদেশের কর্মীরা মালয়েশিয়ায় যেতে পারেন সে বিষয়ে নতুন সরকার কাজ করছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। এজন্য বিদ্যমান সমঝোতা স্মারকে কোনো সংশোধনী আনার কথাও বলেছেন।

জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সভা অনুষ্ঠানের বিষয়েও তিনি গুরুত্বারোপ করেন। মালয়েশিয়ার মন্ত্রী সে দেশে অবস্থানরত অনিয়মিত বিদেশী কর্মীদের বৈধ করার কথাও বলেছেন। বাংলাদেশের মন্ত্রী ইমরান আহমদও বলেছেন, মালয়েশিয়ার এ সরকার কিন্তু নতুন সরকার। আগের সরকারের সঙ্গে যেসব কথা হয়েছে, সেখানে বিরাট একটা পরিবর্তন আসবে। দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এই বিষয়গুলো বাংলাদেশের শ্রমবাজারের জন্য দারুণ ইতিবাচক।

নতুন সরকারের মনোভবে বোঝা যাচ্ছে তারা এতদিন শ্রমবাজার নিয়ন্ত্রনে যে সিন্ডিকেট ছিল সেটি চাইছে না। এর বদলে সব এজেন্সী অবাধে শ্রমিক পাঠাতে পারবে। এতে করে একদিকে যেমন বেশী শ্রমিক যেতে পারবে তেমনি খরচ ও আগের চেয়ে কম হবে। কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়াও সহজ হবে। মালয়েশিয়ার মন্ত্রীর সফরের মধ্য দিয়ে ভালো কিছু হবে, দেশের জন্য ইতিবাচক হবে, স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে এমনটাই আশা করছি। অন্তত এবার যেন সিন্ডিকেট আর দুর্নীতি না হয় সেটাই আশা! আরেকটা কথা, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয় বাংলাদেশের জন্য ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।

কাজেই শুধু মালয়েশিয়া নয় আমাদের এমন একটা পদ্ধতি দরকার যেখানে কম খরচে বা বিনা খরচে বাংলাদেশি কর্মীরা যেতে পারবে বিদেশে। তারা প্রতারিত হবে না। শূণ্য হাতে ফিরবে না। আমি মনে করি নিয়োগকারী দেশ ও প্রেরণকারী দেশ দুই পক্ষ চাইলে এটি সম্ভব। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ দক্ষিণ কোরিয়ার ইপিএস সিস্টেম। সব দেশের ক্ষেত্রে এমন কাঠামো গড়ে উঠুক। ভালো থাকুক আমাদের প্রবাসীরা। ভালো থাকুক বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published.