১৬টি মামলার কোনোটিরই অভিযোগপত্র দেয়নি পুলিশ
শরিফুল হাসান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ মিলনায়তনসহ পুরো শহরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ১০ মাসেও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি। এ ঘটনায় দায়ের করা ১৬টি মামলার কোনোটিরই অভিযোগপত্র দিতে পারেনি পুলিশ। এর মধ্যেই আবার ঘটে গেল নাসিরনগরে মন্দির ও হিন্দু বাড়িঘরে হামলা।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সাহিত্য একাডেমির সভাপতি ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা শাখার সভাপতি কবি জয়দুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অতীতের নাশকতা ও হামলার বিচার হলে নাসিরনগরে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো না। বিএনপির স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বলছেন, মূল অপরাধীদের চিহ্নিত না করে এসব মামলায় শুধুই বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার আর হয়রানি করা হয়েছে।
তুচ্ছ ঘটনায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর জের ধরে গত ১১ ও ১২ জানুয়ারি শহরজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ ও ভাঙচুর চালায় মাদ্রাসার ছাত্ররা। তারা রেলস্টেশন, আওয়ামী লীগের কার্যালয়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সংগীতাঙ্গনসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর চালায়।
ওই হামলায় সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ জাদুঘরের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র, দুর্লভ সব ছবি পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ছাড়া ক্ষুব্ধ ছাত্র ও বহিরাগত দুষ্কৃতকারীরা শহরের পুরোনো কাছারি পুকুরসংলগ্ন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরে থাকা সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয়, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগার, তিতাস সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শিশু নাট্যম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমি, তিতাস ললিতকলা একাডেমি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে।
এ ঘটনায় ১৪ জানুয়ারি সংগীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান সরকার বাদী হয়ে মাদ্রাসার তিন শতাধিক অজ্ঞাতনামা ছাত্রসহ উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসীদের আসামি করে সদর থানায় একটি মামলা করেন। এ ছাড়া রেলস্টেশন, পুলিশের পিকঅ্যাপ পোড়ানোসহ বিভিন্ন ঘটনায় আরও ১৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে পুলিশ বাদী হয়ে দুটি মামলা এবং বাকিগুলো হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া বিভিন্ন ব্যক্তি করেন। মামলায় এজাহারনামীয় ও অজ্ঞাত মিলিয়ে ৯ হাজার ৪৭৮ জনকে আসামি করা হয়।
আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার পুলিশের কর্মকর্তা ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, ‘ভিডিও চিত্র দেখে পুলিশ ওই মামলায় ৩৫ জনকে আসামি করেছে। তারা সবাই বহিরাগত ছিল। তবে এখনো ওই মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া যায়নি। দ্রুত অভিযোগপত্র দেওয়া যাবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রতন কান্তি দত্ত বলেন, ‘এ জেলায় আগেও হিন্দুদের ওপর হামলা হয়েছে; বিচার হয়নি। এসব ঘটনার বিচার হলে আজকে নাসিরনগরে এ ঘটনা ঘটত না।’
জেলা বিএনপির সভাপতি হাফিজুর রহমান মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যেসব ঘটনা ঘটেছে, সব মামলাতেই অকারণে বিএনপির নেতা-কর্মীদের আসামি করা হয়েছিল। ৭০-৮০ জন নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহর আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, বিষয়টিকে কেন্দ্র করে আবারও অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে, এই আশঙ্কায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। তবে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন সরকার বলেন, ‘এ ব্যাপারে কোনো চাপ না থাকায় হয়তো মামলাটি ঝুলে আছে। কিন্তু নাসিরনগরের ঘটনার পর আমরা নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিটি মামলা আলাদা আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত তদন্ত শেষ করতে পুলিশকে বলা হবে।’
মামলাগুলোর অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মঈনুর রহমান বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে তুলকালামের ঘটনায় ১৬টি মামলা হয়েছিল। প্রতিটি মামলায় ৮-১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির নেতা-কর্মীদের হয়রানি ছাড়া আর কিছুই হয়নি, এটা ঠিক নয়। আর ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে তদন্তের জন্য সময়সীমার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যত দিন প্রয়োজন সময় নিয়েই তদন্তকাজ করা হয়। মামলাগুলো স্পর্শকাতর। তাই ধীরেসুস্থে তদন্তকাজ করা হচ্ছে।