শরিফুল হাসান
ভীষণ মন খারাপ হলো ঘটনা দেখে। আসলে বহুদিন পর বুধবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম। আমি আর সাংবাদিকতার শিক্ষক ফাহাদ ভাই মধুর ক্যান্টিনে চা শেষে কলা ভবনের দিকে যাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য টিচার্স ক্লাবে যাবো। হাঁটতে হাঁটতে কলা ভবনের সামনে গিয়ে আরেকজন শিক্ষকের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
এমন সময় হট্টগোল শুনলাম। কী হচ্ছে সামনে গিয়ে এগিয়ে ঘটনা দেখে বেশ স্তম্ভিত হলাম। দেখি এক ছেলে এবং তাঁর সঙ্গে থাকা তাঁর এক বান্ধবী চিৎকার করে পরিচয় দিচ্ছে, আমরা দুজনেই চতুর্থ বর্ষের। তোমরা প্রথম বর্ষের ছেলেরা আমাদের সঙ্গে এমন করছো কেন? সমাজবিজ্ঞান বিভাগের উল্টো দিকে কলাভবনের সামনের ঘটনা। মিনিটখানেকের মধ্যে ঘটনা যা বুঝলাম খুবই স্বাভাবিকভাবে একটা ছেলে-মেয়ে পাশাপাশি বসে ছিল। কিন্তু প্রথম বর্ষের ৪-৫ জন ছেলে গিয়ে সম্ভবত তাদের বহিরগাতভেবে কিছু বলেছে। যাকে বলেছে সে চতুর্থ বর্ষের। তাঁর চেহারায় অপমানের ছাপ। সাথে রাগও। উঁচু গলায় সে পরিচয় দিচ্ছে সে চতুর্থ বর্ষের। প্রথম বর্ষের ছেলেরা যেহেতু দলে ভারী তাদের আবার ইগোতে লেগেছে সেটা। ঘটনা উত্তেজনকার দিকে মোড় নিচ্ছে।
পরিস্থিতি শান্ত করতে আমি আর ফাহাদ ভাই আগালাম। ঝুঁকি আছে জেনেও প্রথম বর্ষের ছেলেদের কাছে গিয়ে বললাম, দেখো আমি ২০ বছর আগে আপনাদের মতো প্রথম বর্ষের ছাত্র ছিলাম। একটা জিনিষ মনে রাখবেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনারা সবচেয়ে জুনিয়র। এই ছেলে আর মেয়েটি কিন্তু স্বাভাবিকভাবেই বসে গল্প করছিলো। তাও সবার সামনেই। আচ্ছা বলেন তো একটা ছেলে-মেয়ের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশাপাশি বসা কী অপরাধ? আর কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর কে বহিরাগত সেটা দেখার জন্য এদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে কে? আমার সঙ্গে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহাদ ভাই তাদের সেটাই বললেন, আচ্ছা কে কীভাবে বসে আছে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমাদের কে দিয়েছে? যাই হোক আমরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে প্রথম বর্ষের ছেলেদের ফেরত পাঠালাম। বললাম তোমরা আমার ছোট ভাইয়ের মতো। শোন তোমাদের নানাজন নানা বড় ভাই নানা কিছু বোঝাবে।
তোমাদের মনে হবে ক্যাম্পাসে তোমরা খুব ক্ষমতাশালী। কিন্তু প্লিজ কাউকে অসম্মানিত করো না।তবে প্রথম বর্ষের ছেলেদের শরীর ও চোখের ভাষায় তখনো উত্তেজনা। মনে হয় না তাদের রাগ কমেছে। একজন বলছিলো, প্রথম বর্ষে সবাই এমন করে। আমি বললাম অনেকেই হয়তো করে। তবে আমি কিন্তু করিনি। কেন আরেকজন মানুষকে অসম্মান করতে হবে? এরপর তারা একটু দূরে সরে গেল। এবার চতুর্থ বর্ষের ছেলে আর মেয়েটিকে বললাম দেখেন আপনারা তো বোঝেন আমাদের প্রথমে বর্ষের ছেলেদের সবাই ব্যবহার করে। আর এরা এখনো বিশ্ববিদ্যালয় বুঝে উঠতে পারেনি। বুঝেছি আপনারা অপমানিত হয়েছে। তারপরেও আপনারাও আরেকটু কম উত্তেজনা দেখাতে পারতেন। আমার কথা শোনার পর তারাও চলে গেল।
আমি হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম বিশ বছর আগের কথা। আমি প্রথম বর্ষেই নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রাতে হলে এসে গণরুমে নানা ঘটনা শুনতাম। আমাদের প্রথম বর্ষের বন্ধুদের কেউ কেউ সন্ধ্যার পর একে ওকে বকা দিয়েছে। কেউ কেউ বহিরাগত ছেলে-মেয়েদের ধরেছে। কেউ কেউ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়েছে রাতে। নানা সব ঘটনা। মেয়েদের নিয়ে আজে বাজে কথা। আমি ওদের সঙ্গে তর্ক করতাম। আচ্ছা কেন আরেকজন মানুষকে অসম্মান করতে হবে? আবার সিনিয়ররা প্রথম বর্ষের বা জুনিয়র ছেলেদের নানাভাবে হয়রানি করছে সেটাও দেখেছি। বিশেষ করে গেস্টরুম কালচার। আজ বিকেলেই খবরে পড়ছিলাম, মাস্টারদা সূর্যসেন হলের ২৪৯ নম্বর কক্ষে বসে অনলাইনে ক্লাস করছিলেন এক ছাত্র।
এ সময় সেখানে প্রবেশ করে সাত-আটজন ‘বড় ভাই।’ ক্লাস চলাকালীন সময়ে ‘ভাইদের’ সালাম দিতে পারেনি সাজ্জাদ। সে কারণে ক্লাস শেষে সাজ্জাদকে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি, থাপ্পড় মারা হয। সাজ্জাদের দাবি, মার খেয়ে তার কানে শুনতে সমস্যা হচ্ছে। এ ঘটনায় হল প্রাধ্যক্ষ বরাবর অভিযোগও করেছে সাজ্জাদ। এই ঘটনাগুলো পড়লে আমার প্রায়ই মন খারাপ হয়। হলের গেস্টরুমে জুনিয়রদের প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনসহ নানা হয়রানি করা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এবং প্রশাসনের উদাসীনতায় যুগের পর যুগ চলছে এই অপসংস্কৃতি।
‘ম্যানার’ শেখানোর নামে সিনিয়র শিক্ষার্থীরা জুনিয়রদের সঙ্গে এমন অশোভন চলছে যুগের পর যুগ। বহুবছর ধরে দেখছি, কেউ ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের কর্মসূচিতে যেতে না পারলে নানা হয়রানি করা হয়। প্রায় দুই দশকের সাংবাদিকতা জীবনে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, জুনিয়রদের অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়া, এক পায়ে দাঁড় করানো, কান ধরে দাঁড় করানো, চেয়ার ছাড়া চেয়ারে বসার ভান করে থাকা, মাটিতে বসে দুই পায়ের ফাঁক দিয়ে কান ধরে মুরগি হওয়া, অর্ধনগ্ন করে ছবি তুলতে বাধ্য করা, ১০০ বার সালাম দেওয়ানো, কান ধরে ওঠবস করানো, দিয়াশলাইয়ের কাঠি বা এক টাকার পয়সা দিয়ে রুমের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ পরিমাপ করানোসহ কতো যে ঘটনা শুনেছি!
আগে ছাত্রী হলগুলোয় তুলনামূলকভাবে এসব কম হলেও এখন মাঝে মধ্যে সেখানেও এমন ঘটনা শুনি। রোকেয়া হলে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে ডেকে নিয়ে গান বাজিয়ে অশ্লিল নাচ নাচানো, নেত্রীদের কাপড় ধুইয়ে দেওয়াসহ অনেক ঘটনা শুনেছি। এসব ঘটনা আমাকে ভীষণ আহত করে। আচ্ছা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র কী করে আরেকজন ছাত্রের গায়ে হাত তোলে? বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটা ছেলে কী করে আরেকজনকে অসম্মান করে? দেখেন প্রথম বর্ষে আসা একজন নতুন শিক্ষার্থী এমনিতে ভয়ে থাকে।
তাদের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত ব্যবহার করা হলে তারা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নির্যাতনের মাত্রা সহ্য করতে না পেরে বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। আপনি নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন। ভাবুন একবার কেউ আপনাকে অসম্মান করলে কেমন লাগে। তাহলে আপনি কেন আরেকজনকে অসম্মান করবেন? আমি মনে করি এসব ঘটনা বন্ধ হওয়া জরুরী। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হল প্রশাসনের এসব নিয়ে আরো কঠোর হওয়া উচিত। ছাত্র রাজনীতির নামে যা চলছে এগুলোই কী আমরা চাই নাকি ছাত্রদের কল্যাণের জন্য রাজনীতি জরুরী?এই দেশের প্রতিটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবাইকে অনুরোধ প্লিজ কাউকে অসম্মান করবেন না।
সিনিয়ররা দয়া করে কখনো জুনিয়রদের নিপীড়ন করবেন না। আপনারা যারা রাজনীতি করেন তারা দয়া করে ভালো ব্যবহার করুণ সবার সাথে। আবার প্রথম বর্ষের কারো ক্যাম্পাসে খবরদারি করা উচিত নয়। মনে রাখেবেন আপনার বড় ভাইয়েরা বা আপনার নেতারা আপনাকে বলবে যা ইচ্ছে করো, আমি আছি। প্রথম বর্ষে আপনার মনে হবে আপনি মহা ক্ষমতাধর। যতো দিন যাবে আপনি বুঝবেন আপনি কিছু না। কাজেই সবাইকে সম্মান করুন। সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের বলবো, কেউ কাউকে অসম্মান করছে দেখলে প্রতিহত করুন। আপনারা সবাইকে বোঝানোর উদ্যোগ নিন।
একটা কথা আমাদের সবার মনে রাখা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শুধু লেখাপড়া করতে আসি না আসি মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে। মানুষ হয়ে কোন মানুষকে অসম্মান করা উচিত না। আরেকটু খোঁজ নেবেন দেখবেন যারা ক্যাম্পাসে আরেকজনকে অসম্মানিত করে তাদের বেশিরভাগেরই পরবর্তী পরিনতি ভালো হয় না।
মনে রাখবেন কাউকে আপনি এই ক্যাম্পাসে এই পৃথিবীতে কাউকে অসম্মানিত করলে আপনিও কোন না কোনদিন কোথাও না কোথাও অসম্মানিত হবেন। কাউকে একটা গালি দিলে আপনিও গালি খাবেন। কাউকে একটা চড় দিলে জীবনদশায় একটা চড় খেয়ে যাবেন। কাজেই সবার কাছে অনুরোধ আমরা যেন সবাই সবাইকে সম্মান করি। ওপরওয়ালা আমাদের সবাইকে বিবেকবোধ দিক। এই বোধ ছাড়া শিক্ষা আর সনদ সবই যে মূল্যহীন!