বাবার জন্য ভালোবাসা

Spread the love

শরিফুল হাসান

নেথা ইসলামের বয়স ৪০; থাকেন যুক্তরাজ্যে; পেশায় সাইকোথেরাপিস্ট। মানে, মনস্তাত্ত্বিক পদ্ধতিতে মানসিক আবেগঘটিত সমস্যার চিকিৎসা দেন তিনি। কিন্তু অসামান্য এক আবেগ এই মেয়েটিকেই তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে ৩৭ বছর ধরে। সেই তাড়না তাঁকে নিয়ে এসেছে বাংলাদেশে; তাঁর বাবার দেশে। তিনি খুঁজছেন তাঁর বাবা ফকরুল ইসলামকে।কেন খুঁজছেন? তিন বছরের একটি মেয়ে বাবার কী কী স্মৃতি মনে রাখতে পারে? নেথা বলছেন, কোনো স্মৃতি নেই। আছে প্রচণ্ড ভালোবাসা, তীব্র আবেগ। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’ কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে নেথার ঘোরতর দ্বিমত। তাঁর পিতা জেগে আছেন তাঁর অন্তরে। হূদয়ের সেই পিতাকে বাস্তবে দেখতে চান, খুঁজে পেতে চান তিনি। বাবার যে ছবিটি তিনি যক্ষের ধনের মতো আঁকড়ে আছেন, তা-ও তো তাঁর যৌবনের। এখন বেঁচে থাকলে দেখতে কেমন হবেন তিনি? আদৌ বেঁচে আছেন কি না? সব প্রশ্নই ভিড় করে মনোবিদের মনে। নিজের এই অভিযাত্রার নাম দিয়েছেন ‘সার্চিং ফর মাই ফাদার’।লম্বা ও ছিপছিপে গড়নের নেথার চোখজোড়া এমনই, যেন সব সময়ই কিছু না কিছু খুঁজছে। প্রথম আলোর কার্যালয়ে এসে যখন বাবাকে নিয়ে কথা বলছিলেন, তখন তাঁর চোখ ছলছল। মায়ের কাছে শুনেছেন, সহজ-সরল আর ভালো মানুষ ছিলেন তাঁর বাবা।ফকরুল ইসলাম ১৯৬০ সালের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাজ্যের ল্যুটনে গিয়েছিলেন। থাকতেন ১২ হাইফিল্ড রোড, ল্যুটনে। সেখানেই পরিচয় ও প্রণয় এক ব্রিটিশ তরুণীর সঙ্গে। ১৯৬৯ সালে ওই তরুণীকে বিয়ে করেন তিনি। ১৯৭০ সালে জন্ম হয় এই দম্পতির প্রথম সন্তান ওমর ইসলামের। নেথার জন্ম ১৯৭১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। মায়ের মতে, পরের বছরগুলো ভালোই কাটছিল। কিন্তু ১৯৭৪ সালে এসে সম্পর্কে চিঁড় ধরে। একপর্যায়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন ফকরুল ইসলাম। তবে সন্তানদের খোঁজখবর রাখতেন তিনি। শেষ চিঠিটি ১৯৭৮ সালে লেখা হয়, যাতে দুই ছেলেমেয়ের খোঁজ নিয়েছেন তিনি।হঠাৎ আতঙ্ক ভর করে নেথার মায়ের মধ্যে—ফকরুল তাঁর ছেলেমেয়েকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে পারেন। সেই আতঙ্ক থেকেই ওয়েলিয়া গার্ডেন সিটি থেকে ছেলেমেয়েকে নিয়ে মা চলে যান করোওয়ালে। নেথা বলে যান, নতুন এই ঠিকানা জানা ছিল না তাঁর বাবার। সে কারণেই বোধ হয়, তাঁর বাবা আর কখনো তাঁদের খোঁজখবর নিতে পারেননি। ছিন্ন হয়ে যায় সব বন্ধন।নেথা বলেন, ‘বড় হওয়ার পর আমি বারবার বাবার সম্পর্কে জানতে চেয়েছি। মা কেবল জানিয়েছেন, বাবার বাড়ি সম্ভবত বাংলাদেশের সিলেটে। যুক্তরাজ্যে তিনি গাড়ি চালনায় প্রশিক্ষণ দিতেন। কিন্তু ১৯৭৮ সালের পর বাবার কোনো তথ্য দিতে পারেননি মা। বাধ্য হয়ে আমি বাংলাদেশে চলে এসেছি।’নেথা বলে চলেন, ‘মা আমাকে বলেছেন, বাবা সব সময় চেয়েছিলেন যোগাযোগ রাখতে। কিন্তু সন্তান হারানোর আতঙ্কে তিনি বাবার সঙ্গে যোগাযাগ রাখতে চাননি। মা হিসেবে তিনি যেটা করেছিলেন, সেটা হয়তো ঠিক ছিল। কিন্তু আমি বাবাকে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থেকে বাংলাদেশে এসেছি। মন বলছে, আমি হয়তো ফিরে পাব বাবাকে।’‘আমি বাবাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আমি চাই, আমার এই ভালোবাসার কথা আমার বাবা জানুক। আমি তাঁর খোঁজ না পাওয়া পর্যন্ত এ দেশেই থাকব’, বললেন নেথা।ইতিমধ্যে নিজের মতো করে কাজে নেমে পড়েছেন নেথা। ‘আমি ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনে গিয়েছিলাম বাবার পাসপোর্ট নম্বর, ঠিকানাসহ যেকোনো তথ্যের খোঁজে। কিন্তু তাদের কাছে এত আগের তথ্য নেই। কিন্তু আমি আশা ছাড়িনি। বাংলাদেশের মানুষের সহযোগিতা আমাকে মুগ্ধ করেছে; অনুপ্রাণিত করেছে।’বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় ইতিমধ্যেই মুগ্ধ নেথা ইসলাম। তাঁর বিশ্বাস, এ দেশের মানুষের মতোই পারিবারিক বন্ধনে অভ্যস্ত তাঁর বাবা। তিনি বলেন, ‘আমার শরীরে বাঙালির রক্ত। এতে আমি দারুণ খুশি।’বাবাকে খুঁজে না পেলে কষ্টই পাবেন নেথা। তবে তাঁর উদ্যোগকে তিনি স্মরণীয় করে রাখতে চান। নেথা বললেন, ‘বাংলাদেশে এই সফর আমার পুরো জীবনটাই বদলে দিয়েছে। এই অভিযান নিয়ে আমি একটা বই লিখতে চাই। বইয়ের নাম হবে “সার্চিং ফর মাই ফাদার ইন দ্য মাদারল্যান্ড, বাংলাদেশ”। আমি এই বইটা উৎসর্গ করতে চাই বাবাকে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.