শরিফুল হাসান
বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ফায়ারফাইটার মেহেদি হাসানের (৩৫) শ্বাসনালীর কিছু অংশ পুড়ে গেছে। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস জানিয়েছে, বঙ্গবাজারে আগুন নিয়ন্ত্রণের এসেছিলেন কল্যাণপুর ফায়ার স্টেশনের ফায়ারফাইটার মেহেদি হাসান (৩৫)। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সহকর্মী বিকাশ (২২)। আগুন নেভাতে মই দিয়ে বঙ্গবাজারের তৃতীয় তলায় উঠেছিলেন তারা। কিন্তু স্টিলের দরজার কারণে ভেতরে পানি দিতে পারছিলেন না তারা। মেহেদি দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। ওই সময় ভেতর থেকে প্রচণ্ড ধোঁয়া তার নাকে মুখে এসে লাগে। এতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন মেহেদি। পরে মেহেদি ও বিকাশকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে নিয়ে যান তার সহকর্মীরা। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় পরে মেহদিকে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়।
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘মেহেদির শ্বাসনালীর কিছু অংশ পুড়ে গেছে।’ মেহেদির সহকর্মী মোস্তাফিজুর রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সবাই দোয়া করবেন মেহেদি যেন দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন।’
অন্তর থেকে মেহেদির জন্য দোয়া করছি। শুধু মেহেদি নয় আজকে আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক বাবুল চক্রবর্তীসহ সোহেল, রবিউল ইসলাম অন্তর ও আতিকুর রহমান রাজনসহ মোট পাঁচজন আহত হয়েছন।
আপনারা হয়তো জানেন, উৎসৃক জনতা, পানির অভাব, প্রতিকূল আবহাওয়াসহ নানা প্রতিবন্ধকতার পরেও ফায়ার সার্ভিসের ৪৮টি ইউনিট প্রায় সাড়ে ছয় ঘণ্টার অক্লান্ত পরিশ্রমে বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে। আফসোস এতো কষ্ট করলেন যারা সেই ফায়ার সার্ভিসে আজকে হামলা হয়েছে।
সকাল পৌনে ১০টার দিকে বিক্ষুব্ধ জনতা ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তরে হামলা করে। তাদের হাত থেকে বাঁচতে কর্মীরা ভবনের ভেতরে নিরাপদে অবস্থান নেন। হামলার এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো.মাইন উদ্দিন বলেন, ‘কেন আমাদের সদস্যদের ওপর আক্রমণ? কেন আঘাত?
গত এক বছরে ১৩ জন ফায়ার কর্মীর প্রাণ গেছে উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, ‘নিহত ১৩ ফায়ার ফাইটার অগ্নিবীর খেতাব পেয়েছেন। এছাড়া ২৯ জন আহত হয়েছেন। আজকে আমাদের আটজন সদস্য আহত হয়েছেন। কেন বা কারা ফায়ার সার্ভিসের ওপর আঘাত আনলো আমার বোধগম্য নয়।’
আমি বলবো এটি ভয়াবহ ন্যাক্কারজনক ঘটনা। আপনারা যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন তাদের ক্ষমা চাওয়া উচিত। এই হামলাকারীদের চিহিৃত করা উচিত। কারণ ফায়ার সার্ভিসকে আমি লি বাংলাদেশের বীরের এক বাহিনী।
এই কয়েকদিন আগেও আমি লিখেছি, আমার প্রায় দুই যুগের সাংবাদিকতা জীবনে রানা প্লাজায় ভবন ধ্বস, লঞ্চডুবি, তাজরীন গার্মেন্টস, নিমতলীর আগুনসহ অনকে ঘটনা সরাসরি কাভারে করেছি। বহু ঘটনার খবর পড়েছি। প্রতিটা ঘটনায় দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অসাধারণ কাজ করে। একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়!
২০১২ সালের মার্চ মাস। মেঘনায় এমভি শরীয়তপুর-১ নামে একটা লঞ্চডুবেছে। শত শত মানুষ নিখোঁজ। উদ্ধারকারী জাহাজে বসে মানুষের আহজারি দেখছি। প্রথম আলোর সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে সেই আহাজারির খবর পত্রিকায় লিখে পাঠাচ্ছি।
ঘটনার দুদিন পর স্বজনেরা জীবনের আশা ছেড়ে দিয়ে লাশের জন্য আহাজারি করছে। এই বাহিনী সেই বাহিনীর দেশি বিদেশি ট্রেনিং পাওয়া নানা লোকজন আসছে আধুনিক সব সরঞ্জামন নিয়ে। তারা পানির নিচে যায়। কিন্তু খুব একটা লাশ উদ্ধার হয় না। সেই সময় হাজির হলেন শুকনো রুগ্ন লিকলিকে শরীরের ফায়ার সার্ভিসের এক ডুবুরি। একেকটা ডুব দেয়। দুইটা করে লাশ তোলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে একাই ৩০-৩৫ টা লাশ উদ্ধার করলেন। সব বাহিনীর সদস্যরা বিস্ময় নিয়ে তাকে দেখছে। বিস্মিত আমিও।
শুকনো শরীরের লোকটার নাম আবুল খায়ের। ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি। অসম্ভব সাহসী মানুষ। তাই তো প্রচণ্ড স্রোত বা যতো প্রতিকূল পরিস্থিতিই হোক, ডাক পড়ে আবুল খায়েরের। উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানতে চায়, আবুল খায়ের, তুমি কি যেতে পারবে?’ তার উত্তর, ‘পারব স্যার। কিন্তু ফিরে আসতে পারব, সে আশা নাই। আমি মারা গেলে স্যার লাশটা বাড়িতে পাঠায় দিয়েন।’
এই হলো আবুল খায়ের। রানা প্লাজার উদ্ধার অভিযানে আমি তাকে দেখেছি। দেখেছি আরো অনেক ঘটনায়। আসলে বাংলাদেশ ফায়ার ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য যেন একেকজন আবুল খায়ের। দুর্ঘটনা বা আগুন লাগার পর প্রতিটা ঘটনায় দেখেছি ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা অসম্ভব ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন।
শুধু আগুন নেভানোর কাজ করতে গিয়ে অনেক ফায়ার গত সাত বছরে অন্তত ২০ জন সদস্য প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন অরো অনেকে। এই তো গতবছর সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন নেভাতে গিয়ে অন্তত ছয়জন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীর প্রাণ যায়। আহত হয় অন্তত ২১ জন। বছর তিনেক আগে বনানীতে ফায়ার সার্ভিসের উঁচু ল্যাডারে (মই) উঠে এফ আর টাওয়ারের আগুন নেভানো ও আটকে পড়া ব্যক্তিদের উদ্ধার কাজ করতে হিয়ে সোহেল নামে এক ফায়ার কর্মী মারা যান। এমন ঘটনা অনেক।
আজকে যে ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে তারা কাজ করেছে তাতে তো তাদের শ্রদ্ধা জানানো উচিত। আমি অনেকবার লিখেছি, বীরের বাহিনী ফায়ার সার্ভিস।
নানা সংকটে কাজ করতে হয় ফায়ার সার্ভিসকে। এই লেখায় যে আবুল খায়েরের কথা বলছিলাম, যার জীবনটা বীরের, গোটা দেশের সব বাহিনী মিলে যেখানে একজন খায়ের বিরল, সেই খায়েরের সংসার চলে অতিকষ্টে। ছেলেটা তার লেগুনা চালায়। স্ত্রী ক্যানসারে আক্রান্ত বলে জানতাম। অনেকদিন ধরে খোঁজ জানি না।
কিছুটা আধুনিকায়ন হলেও আবুল খায়েরের মতোই নানা সংকটে আমাদের ফায়ার সার্ভিস। তারপরেও দেখবেন, দিন হোক, গভীর রাত হোক, একটা ইমার্জেন্সি কলেই ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সাইরেন বাজিয়ে সবার আগে হাজির ঘটনাস্থলে। অবশ্য আরও অনেক বাহিনীর সদস্যদের ঘটনাস্থলে দেখবেন। আসলে সবাই কম-বেশি কাজ করে। কিন্তু আমার সবসময় মনে হয়েছে, ফায়ার সার্ভিস অসাধারণ এক বাহিনী।
বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিস প্রতিটা সদস্য আমার বীর মনে হয়। মনে হয়, অন্য অনেক বাহিনীর মতো আধুনিক যন্ত্রাপাতি বা পেশাদারিত্ব থেকে হয়তো তারা অনেক পিছিয়ে কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটা সদস্য মমত্ববোধ নিয়ে, মানবপ্রেম নিয়ে নিরলস চেষ্টায় সবার থেকে এগিয়ে। তাই সুযোগ পেলেই আমি বলি তাদের জন্য লিখি।
২০২৩ সালে জনসেবায় স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়ঠে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। দুর্ঘটনা, দুর্যোগ আর দুর্বিপাকের এই দেশে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি সদস্যকে আমার সত্যিকারের হিরো মনে হয়। আনসাং হিরো শব্দটা আসলে তাদের জন্যই। আমি মনে করি এই বাহিনীর আরো আধুনিকায়ন হওয়া দরকার। দরকার আধুনিক সব সরঞ্জাম ও প্রযুক্তি। কারণ যখন তখন আগুন লাগার আর দুর্ঘটনার এই শহরে, দুর্যোগের এই দেশে তারাই আসল নায়ক। এই বাহিনীর প্রতিটা সদস্যকে তাই আজকে আবার ভালোবাসা ও স্যালুট।