প্রভাতফেরি

Spread the love

শরিফুল হাসান

প্রভাতফেরিতে স্কুলের কোন ছোট্ট শহীদ মিনারে ফুল দিতে যাওয়া বাচ্চাগুলোর চোখেমুখে যে শ্রদ্ধা ভালোবাসা থাকে, মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে যাওয়া অধিকাংশ বড় মানুষগুলোর চোখেমুখে সেই ভালোবাসা দেখি না কেন? কেন যেন মনে হয়, বড়দের একটা বড় অংশ নিজেকে দেখানোর প্রতিযোগিতা করে আর ছোটরা শ্রদ্ধা দেখায়।

আসলে রাত ১২ টার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে লাইভ, সবার হুড়োহুড়ি, মুখ দেখানো এসব কিছুর চেয়ে কেন জানি একুশের প্রভাত ফেরি অনেক বেশি স্পর্শ করে। বিশেষ করে একুশের গান গাইতে গাইতে ফুল হাতে ছাত্র-ছাত্রীদের খালি পায়ে হেঁটে চলা। আমাদের শৈশবেও আমরা তাই করেছি। জানি না এই রাতে শ্রদ্ধা জানানোর প্রথা কীভাবে চালু হলো। শুনেছি স্বৈরাচার এরশাদ আমলে এর শুরু।

ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির কথা আমরা সবাই জানি। ইতিহাস বলছে, এই ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে প্রথমবারের মতো ১৯৫৩ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পালিত হয়। ওই দিন ঢাকার বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা খুব ভোরে ছাত্রাবাসগুলো থেকে বের হয়ে খালি পায়ে ফুল হাতে আসেন শহীদ মিনারে। এভাবেই প্রভাতফেরির মাধ্যমে শহীদ দিবস পালন শুরু।

এরপর সেটা চলতেই থাকে। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে যে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল ভাষা শহীদদের রক্তে সেই রাজপথে জুতা পায়ে হেঁটে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে যাবেন না এমন চিন্তা থেকেই খালি পায়ে প্রভাতফেরির প্রথা চালু হয়েছিল বলে জানা যায়। বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে জাতীয় সব নেতা প্রভাতফেরিতে যোগ দিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিয়েছেন। কিন্তু স্বৈরাচার এরশাদ ক্ষমতায় আসার পরে রাতে ফুল দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করেন বলে জানা যায়।

তথ্য ঘেঁটে জেনেছি, ১৯৮৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রভাতে ফুল দিতে গিয়ে এরশাদের মন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরী ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়েন। ছাত্ররা তার পাঞ্জাবি খুলে নিয়েছিলেন। এরপর থেকেই রাতে ফুল দেওয়ার নিয়ম শুরু হয়। সকালে বা দিনের বেলা ফুল দিতে এলে স্বৈরাচার এরশাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বিক্ষোভের মুখে পড়বেন এমন আশঙ্কায় রাত ১২ টা ১ মিনিটে শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি চালু করেন এরশাদ। এরশাদ নেই কিন্তু তাঁর বানিয়ে দেওয়া বহু আচার এখনো বহাল তবিয়েতে চালু আছে।

গণতান্ত্রিক সরকারগুলো সব ক্ষমতায় আসলেও রাতের বেলা শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি আর বন্ধ হয়নি। বরং এরশাদের বহু কিছু টিকিয়ে রেখে বা নিজেরা আরও খারাপ হয়ে এরশাদকেই যেন কম খারাপে পরিনত করেছে। এখন সারারাত লাইভ, কে কার আগে ফুল দেবেন, টিভিতে মুখ দেখাবেন যেন সেই প্রতিযোগিতা চলে। ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশে এখন রাতে ফুল দেয় নীতি নির্ধারকরা।

আর একদু’দিন পর সারা দেশের সব শহীদ মিনারের ফুল আর শ্রদ্ধা যেন হারিয়ে যায়! ভাষাসংগ্রামী আহমদ রফিকের একটা সাক্ষাতকার পড়েছিলাম যেখানে তিনি বলেছেন, ‘১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো আমরা শহীদ দিবস পালন করি। দিবসটি পালন শুরুই হয়েছিল প্রভাতফেরি দিয়ে। বাংলা বর্ষ গণনায় দিনের শুরু হয় সূর্যোদয় থেকে। কিন্তু খ্রিস্টাব্দ গণনার ক্ষেত্রে দিন শুরু হয় রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে। ২১ ফেব্রুয়ারি যেহেতু ভাষা ও স্বাধিকারের বিষয়, সেহেতু প্রভাতফেরিটা ভোরবেলায়ই করা উচিত বলে আমি মনে করি।

আমিও তাই মনে করি। আসলে আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, জাতীয় সংগীতের এই লাইনগুলোর পর দ্বিতীয় যে গানের সুর হৃদয় কাঁপিয়ে দেয় সেটি, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কী ভুলিতে পারি! কী কথা, কী সুর! যেন শিরায় শিরায় ছড়িয়ে যায় কথাগু‌লো। চোখ ভিজে যায়।

কেন জানি মনে হয়, খা‌লি পায়ে হাতে ফুল নিয়ে প্রভাত ফে‌রির মধ্যে দিয়ে দেশকে ভালোবাসার যে শুরু আর কোন কিছুর সাথেই তার তুলনা হতে পারে না। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহচরররা তাই করেছেন। এখনো বেশিরভাগ মানুষ বিশেষ করে স্কুল কলেজের ছাত্র ছাত্রীরা প্রভাতে ফুল দেয়।

ভোরবেলায় ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গাইতে গাইতে খালি পায়ে সবাই শহীদ মিনারে যাচ্ছে এর চেয়ে সুন্দর আর কোন দৃশ্য নিশ্চয়ই হতে পারে না! সবার মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হোক। ভালো থাকুক প্রিয় বাংলাদেশ!

Leave a Reply

Your email address will not be published.