কুয়েতে জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ সাড়ে তিন বছর
শরিফুল হাসান
বাংলাদেশের অন্যতম শ্রমবাজার কুয়েত। দেশটিতে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি আছেন। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ এই দেশটিতে তিন বছর ধরে বাংলাদেশি জনশক্তি রপ্তানি বন্ধ আছে। বাজারটি চালু করতে কূটনৈতিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট মহল আশা করছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন কুয়েত সফর পরিস্থিতি বদলে দেবে। সরকারের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, আগে বছরে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার মানুষ কুয়েতে যেতেন, আর ২০০৯ সালে গেছেন মাত্র ১০ জন। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শ্রমবাজার সৌদি আরবেও শ্রমশক্তি রপ্তানির পরিস্থিতি ভালো নয়। এক বছর ধরে সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানি প্রায় বন্ধ আছে। প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরের পর বাজারটি ফের চালু হবে এমন আশা করা হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। ২০০৯ সালে ১৪ হাজার ৬৬৬ জন কর্মী দেশটিতে গেছেন। একই সময়ে ফিরেছেন ২৭ হাজার ৩০৪ জন। একই অবস্থা মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রেও। ২০০৯ সালে দেশটিতে গেছেন ১২ হাজার ৪০২ জন। ফিরেছেন ১৬ হাজার ৮৭৭ জন। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, বাংলাদেশের প্রবাসী ৭০ লাখ কর্মীর মধ্যে ৩৫ লাখই থাকেন এই তিন দেশে। কাজেই এই তিন দেশের বাজার চালু করতে না পারলে জনশক্তি খাতে দুরবস্থা নেমে আসবে। এই দুরবস্থার মধ্যে কাল রোববার তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে কুয়েতে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রীও থাকছেন তাঁর সফরসঙ্গী। জনশক্তি রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরা আশা করছেন, প্রধানমন্ত্রীর এই সফরের পর কুয়েতের বাজার আবার চালু হবে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক খোরশেদ আলম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই তিনটি দেশ বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার। সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার চালু করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন। রোববার তিনি কুয়েত সফরে যাচ্ছেন। এই সফরে জনশক্তি রপ্তানির বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।’ তিনি বলেন, উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় কুয়েতে বাংলাদেশি শ্রমিকদের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা কুয়েত পুনর্গঠনে নানাভাবে সাহায্য করেছেন। বিষয়গুলো তাঁদের ভোলার কথা নয়। কাজেই এই সফরের পর বাজারটি চালু হবে বলে আশা করা যায়। জনশক্তি রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বায়রার সভাপতি গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘কুয়েতের মতো একটি শ্রমবাজারে ২০০৯ সালে মাত্র ১০ জন লোক গেছে। এই তথ্য মন খারাপ করে দেয়।’ তিনি বলেন, কুয়েত, সৌদি আরব ও মালয়েশিয়ার বাজার চালু করতে না পারলে শ্রমশক্তি রপ্তানির ভবিষ্যত্ অন্ধকার। তিনি আশা করেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর কুয়েতের বাজার আবার চালু হবে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, ১৯৭৬ সালে ৬৪৩ জন কর্মী কুয়েতে গিয়েছিলেন। এরপর প্রতিবছরই এই সংখ্যা বেড়েছে। ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধে কুয়েতের পক্ষে অবস্থানের কারণে দেশটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বেড়ে যায়। ওই বছর ২৮ হাজার ৫৭৪ জন কর্মী কুয়েতে যান। পরের বছর এই সংখ্যা ছিল ৩৪ হাজার ৩৭৭। এরপর প্রতিবছরই গড়ে ১৫ থেকে ২০ হাজার কর্মী কুয়েতে গেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি বদলে যায় ২০০৬ সালে। কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিব (শ্রম) কে এম আলী রেজা প্রথম আলোকে বলেন, ২০০৬ সালের শেষে হঠাত্ করেই কিছু বাংলাদেশি হত্যা, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৬ সালের অক্টোবরে কুয়েত সরকার বাংলাদেশ থেকে লোক নেওয়া বন্ধ করে দেয়। বিএমইটির হিসাব অনুযায়ী, এ ঘটনার পর ২০০৭ সালে কুয়েতে গেছেন মাত্র চার হাজার ২১২ জন লোক। অথচ আগের বছরেও সেটি ছিল ৩৫ হাজার ৭৭৫ জন। ২০০৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩১৯ জন। কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস সূত্র জানায়, বেশ কিছু বাঙালি মাদক ব্যবসা, খুন-ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িত। প্রায়ই কুয়েতের পত্রিকায় এসব খবর থাকে। ফলে বাংলাদেশ নিয়ে কুয়েতিদের মধ্যে যে ইতিবাচক ধারণা ছিল, তা নষ্ট হতে চলেছে। কূটনৈতিক তত্পরতা নেই: কামরুল হোসেন বাবলু নামে কুয়েতের এক বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রথম আলোকে জানান, এখনো কুয়েতের বেশির ভাগ মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে। এখনো বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু তিন বছর ধরে বাজারটি বন্ধ থাকার পরও সরকারিভাবে সেটি চালুর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।বায়রার সভাপতি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে জোর কূটনৈতিক তত্পরতা চালালে কুয়েতে পুনরায় বাংলাদেশের শ্রমিক পাঠানো যাবে।বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কুয়েতের প্রথম সচিব কে এম আলী রেজা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের পর কুয়েতের বাজার চালু হবে বলে আশা করা যায়।