শরিফুল হাসান
প্রথম আলোর সাংবাদিক ও সাভারের নিজস্ব প্রতিবেদক Samsuzzaman Shams কে আটকের খবরটা শুনে বুকটা ভেঙে যাচ্ছে। জানি না ওর অপরাধ কী! সাংবাদিক হওয়া নিশ্চয়ই অপরাধ নয়। শামসের ভাই পুলিশের এএসপি রবিউল করিম গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গিদের প্রতিরোধ করতে গিয়ে নিহত হয়েছিলেন। অনেক বছর ধরে শামসকে চিনি। শামস আমার ভীষণ পছন্দের এক তরুণ।
শামস প্রথম আলোর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ছিলেন। আমার একযুগের প্রথম আলোর সাংবাদিকতা জীবনে সব বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টারদের সাথে কাজ করার সুযোগ হয়েছে। সেই সূত্রে শামসের সাথেও কাজ করেছি। হোলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলায় শামসের ভাই রবিউল মারা যাবার পর পরিবারটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানি। সত্যিকারের দেশপ্রেমিক ও সৎ মানুষদের একটা পরিবার।
আজ সকালটা শুরু করেছিলাম বীর মুক্তিযোদ্ধা শাফী ইমাম রুমীকে স্মরণ করে। সেখানে লিখেছিলাম, ওপর থেকে দোয়া করবেন রূমী ভাই যেন এই দেশে আপনার মতো লাখো রুমী জন্ম নেয় শত সংকটেও যাদের বুকের মধ্যে থাকবে বাংলাদেশ। আমার কাছে শামস ও তাঁর ভাই দুজনেই দেশপ্রেমিক ছেলে।
শহীদ রূমীর কথা ফেসবুকে পোস্ট করার সময় ফেসবুকে কয়েকজন সাংবাদিকের স্ট্যাটাসে দেখি, আজ ভোর ৫টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন আমবাগান এলাকার ভাড়া বাসা থেকে শামসকে আটক করা হয়েছে। এ সময় তাঁর একটি ল্যাপটপ, দুইটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যাওয়া হয়।
সম্প্রতি প্রথম আলোতে স্বাধীনতা দিবসের যে সংবাদটি নিয়ে আলোড়ন হয়, সেই সংবাদটি শামস করেছিলেন। শামসের রিপোর্টে কিন্তু কোন ভুল ছিল না। তবে প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জন্য যে ছবি কার্ড করা হয়েছিল সেখানে মৌসুমি ফুল বিক্রেতা শিশু সবুজের ছবি ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বক্তব্য ছিল দিনমজুর জাকির হোসেনের। নিউজে কোন ভুল না থাকলেও ফেসবুক কার্ডে ভুল হয়।
প্রথম আলো বলছে, পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের। এখানে কিন্তু শামসের কোন দায় ছিল না।
আপনি বলতে পারেন অবশ্যই প্রথম আলোর বার্তা বিভাগের আরো সতর্ক থাকা উচিত যেন এমন ভুল না হয়। কিন্তু এটাও সত্য সংবাদপত্রে কিন্তু অনেক ভুল হয়। ভুল হলে সংশোধন দেবে এটাই নিয়ম। এরপরও কেউ ক্ষুব্ধ হলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন। গত কয়েকদিন ধরে এ নিয়ে প্রথম আলোর অনেক সমালোচনা হচ্ছে। এই সমালোচনাই যথেষ্ট ছিল। এরপরও প্রেস কাউন্সিল আছে। আদালত আছে। এসব বাদ দিয়ে ইচ্ছে হলেই একজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়া যায় না। এমন ঘটনায় সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয় না বরং ক্ষুন্ন হয়। বিশেষ করে যেভাবে একজন সাংবাদিককে তুলে নেওয়া হয়েছে সেটা সভ্য দেশে হয় না।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার ভোর চারটার দিকে তিনটি গাড়িতে মোট ১৬ জন শামসুজ্জামানের বাসার সামনে যান। ৭-৮ জন বাসায় ঢোকেন। একজন শামসুজ্জামানের থাকার কক্ষ তল্লাশি করে তাঁর ব্যবহৃত একটি ল্যাপটপ, দুইটি মুঠোফোন ও একটি পোর্টেবল হার্ডডিস্ক নিয়ে যায়। এরপর তাঁকে নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যান তাঁরা।
আটকের সময় শাসসের বাসায় ছিলেন স্থানীয় সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাসায় এসে তাঁরা জব্দ করা মালামালের তালিকা করেন। শামসুজ্জামানকে জামাকাপড় নিতে বলা হয়। এ সময় কক্ষের ভেতরে দাঁড় করিয়ে তাঁর ছবি তোলা হয়। ৫-৭ মিনিটের মধ্যে আবার তাঁরা বের হয়ে যান। বাসা তল্লাশির সময় দুইবারই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা সুদীপ্ত শাহীন উপস্থিত ছিলেন।’
তুলে নেওয়ার সময় ওই বাসার মালিককে ডাকেন পুলিশের এক কর্মকর্তা। পুলিশ তাঁকে জানায়, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে নেওয়া হচ্ছে।
ভীষন অবাক হলাম! সংবাদের ভুল সংশোধন বা প্রত্যাহারের পর একজন সাংবাদিককে আটক এবং তাঁর বাসা থেকে বোমা বারুদের মতো ল্যাপটপ, হার্ডডিস্কসহ আটকের ভাষ্য ভীষন কষ্টদায়ক! অপমানজনক!
আগেই বলেছি, শামসের সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক বছরের। ভীষণ সৎ ছেলে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবসময়ের সেরা রিপোর্টারদের মধ্যে শামস অন্যতম। কোন প্রলোভনে মাথা নোয়ায়নি। আমি মুগ্ধ হতাম ওর কাজে। পড়াশোনা শেষ করে শামস ঢাকায় এসে দৈনিক বণিক বার্তায় নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করে।
নূর সিদ্দিকী ভাই লিখেছেন, একভাই পুলিশে আরেকভাই সাংবাদিক এটা শামসের মা মানতে পারছিলেন না। বিশেষ করে ২০১৬ সালের ১লা জুলাই শামসের বড়ভাই রবিউল জঙ্গি হামলায় শহিদ হওয়ার পর মায়ের কথায় সাংবাদিকতা ছেড়ে শামস অন্য কিছু করার চেষ্টা করে। পরে একটি ব্যাংক চাকরি শুরু করে। পোস্টিং সাভারে। কিন্তু বছর না ঘুরতেই শামসের কান্নাকাটি শুরু হয়। ওর মাও কান্না করে। শামস আবার প্রথম আলোতে যোগ দেয়। আসলে সাংবাদিকতা অন্তরে থাকলে এমনি হয়।
এরপর শামস প্রথম আলো ছেড়ে দৈনিক সমকালে নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে ঢাকায় কাজ শুরু করে। ক্রাইম বিটে খারাপ করছিলো না। কিন্তু কিছুদিন পরই সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়। এরপর সমকালে পদত্যাগ পত্র দিয়ে ফের প্রথম আলোতেই যোগ দেয়।
নূর ভাই লিখেছেন, না জানিয়ে ফের সাভারে প্রথম আলোতে যোগ দেওয়ায় ওর উপর অভিমান করি। কিন্তু ভাইইইইইইই বলে ডাক দিলে আর অভিমান থাকে না। একদম সত্য কথা। ওর মধ্যে এমন একটা মায়া থাকে ভাই বলে যখন ডাক দেয় ভীষন আদর করতে ইচ্ছে করে ছোট ভাইয়ের মতো। ইনবক্সজুড়ে ওর সঙ্গে নানা সময়ের নানা আলাপ দেখছিলাম। আমার সঙ্গে কতো বিষয় যে শেয়ার করতো! ভীষণ সৎ ও দেশপ্রেমিক শামস।
আমার খুব কষ্ট লাগে এমন একটা ছেলেকে আটক করা হয়েছে। অবশ্য আশুলিয়া থানার ওসি, ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার কিংবা সিআইডির ঢাকা বিভাগের উপমহাপরিদর্শক এখনো শামসকে আটকের কথা নিশ্চিত করেননি। আমি চাই এই কথাগুলো সত্য হোক। আমি খুব খুশি হবো যদি শুনি শামসকে কেউ আটক করেনি। কারণ একজন সাংবাদিককে এভাবে আটকানো কোন সুস্থ স্বাভাবিক কাজ নয়!
এই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করছি, শাসসকে ছেড়ে দিন। দয়া করে তাঁর বিরুদ্ধে কোন মামলা করবেন না। জঙ্গি হামলায় নিহত এক শহীদের মায়ের কথা ভাবুন। এক ছেলে পুলিশ দেশের জন্য মরেছে, আরেকজন সাংবাদিক সে যদি পুলিশের হাতে আটক হয় ওই মায়ের অবস্থাটা ভাবুন। আশা করছি আপনারা ভাববেন। একই সাথে অনুরোধ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করুন। দয়া করে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করুন। একটা সুন্দর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করুন। স্বাধীনতার এই মার্চ মাসে এই রাষ্ট্র ও সরকারের কাছে এটাই আমার চাওয়া-হাতেজোড় করে চাওয়া।