শরিফুল হাসান
গত কয়েকদিন ধরে খবরগুলো পড়ছি আর ভাবছি। দেখেন পুলিশের একজন কর্মকর্তাকে পিটিয়ে মারা হলো, এরপর গাড়ির ডালায় করে গাজীপুরের জঙ্গলে লাশ নিয়ে পোড়ানো হলো-এমন বর্বর ঘটনার যদি বিচার না হয়, এমন বর্বর ঘটনার আসামিরা যদি পালিয়ে যায় তাহলে সাধারণ মানুষ বিচার পাবে কী করে?
তবে এই ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। বরং এই ঘটনায় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ক্ষমতাবানদের ক্ষমতা, রাজনৈতিক সখ্যতা, দুর্নীতি অনিয়ম থেকে শুরু করে এই রাষ্ট্রের সামগ্রিক ব্যর্থতাই ফুটে উঠে।শুরু থেকে একবার ভাবেন ঘটনাগুলো! একজন অপরাধী ঢাকার বনানীর মতো জায়গায় ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা ও চাকরিজীবীদের ফাঁদে ফেলতেন কিন্তু আইনশুঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেটা জানে না কিংবা জানলেও থামাতে পারে না।
ফলাফল বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে একদিন পুলিশ কর্মকর্তা মামুনও সেই অপরাধের শিকার।একবার ভাবেন অপরাধীরা কতোটা শক্তিশালী হলে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকেও ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেন। এরার হাত-পা বেঁধে পেটান। এরপরে বস্তায় ভরে গাজীপুরের জঙ্গলে নিয়ে লাশ পোড়ান। আচ্ছা একজন পুলিশের লাশ বস্তায় ভরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গাড়িতে কেন পুলিশ টের পায় না? আমাদের পুলিশ চেকপোস্টগুলো কী করে তাহলে? বনানী, গুলশান, খিলক্ষেত এয়ারপোর্ট হয়ে চলে যান আমাদের কোন পুলিশ টের পান না। কেন পান না?এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আপনি যে কোন পুলিশ চেকপোষ্টে একদিন দাঁড়ান।
দেখবেন মোটরসাইকেল আর সিএনজি সব চেক হচ্ছে। আমি আমার ২১ বছরের ঢাকার জীবনে কোনদিন কোন পুলিশ চেকপোস্টে কোন দামী গাড়ি বা পাজরো চেক করতে দেখিনি। তারমানে আপনি দামী গাড়িতে করে যা ইচ্ছে নিয়ে যান, এমনকি লাশ দেখবেন কেউ দেখবে না।এবার পরের ঘটনায় যান।
২০১৮ সালের ৭ জুলাই খুন হলে পুলিশের বিশেষ শাখার পরিদর্শক মামুন। ঘটনার তিনদিন পর নিহত পুলিশ কর্মকর্তার ভাই বাদী হয়ে হত্যা মামলা করলেন। সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা ঘটে তখুনি। আপনি একবার ভাবেন একজন পুলিশকে হত্যা করে পুড়িয়ে মারার মামলার আসামিকে ধরেও ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ।এই মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র পুলিশের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাদ্যম বলছে, পুলিশ কর্মকর্তা মামুন হত্যার ঘটনায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানকে সে সময় আটক করেছিল ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
কিন্তু আটকের তিন দিন পর তাঁকে গ্রেপ্তার না দেখিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। মূলত ক্ষমতাসীন দলের তৎকালীন এক প্রভাবশালী নেতা ও তখনকার একজন অতিরিক্ত মহাপরিদর্শকের অনুরোধে ডিবি তাঁকে ছেড়ে দেয়।ঘটনাগুলো পড়ে স্তব্ধ হয়ে যাই। একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে খুন করে পুড়িয়ে মারার ঘটনার আসামিকেও ছেড়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমতাশীলরা তদবির করে আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও ছেড়ে দেয়! আমি মনে করি এই ঘটনা পুরো বাংলাদেশের ব্যর্থতা!
একজন পুলিশের কপালে এই ঘটলে সাধারণ মানুষ কী করে ন্যায়বিচার পাবে?পরের ঘটনা তো আপনারা সবাই জানেন! সিনেমার মতো ঘটনা। সবার সামনে একজন আসামি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে যাচ্ছেন। সেখানে বিয়ে করছেন। ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভারতীয় পাসপোর্ট তৈরি করছেন। সেখান থেকে দুবাই। আর এখন তিনি বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও যখন ইচ্ছে বাংলাদেশে আসেন। ফেসবুকে নিয়মিত লাইভ করেন। কিন্তু কেউ কিছু দেখে না।
যেই না ক্রিকেটার সাকিব তাঁর সোনার দোকান উদ্বোধনী করতে গেলেন ছি ছি পড়ে গেল।সাকিব ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে নিশ্চয়ই নৈতিক কাজ করেনি। কিন্তু প্রশ্ন হলো পুলিশকে খুন করে কী করে একজন আসামি পার পেয়ে যায়? কেন তাকে ধরেও ছেড়ে দেওয়া হয়। হিরো আলম যে কথাটা বলেছেন সেটা কিন্তু একদিক থেকে সত্যি।
হিরো আলম বলেছেন, ‘খুনের মামলায় অভিযুক্ত একজন আসামিকে এত দিন খুঁজে না পাওয়া বা গ্রেপ্তার করতে না পারার ব্যর্থতা পুলিশের। আমরা ফেসবুকে পোস্ট না দিলে, দুবাই না গেলে আরাভ খানের আসল পরিচয় কেউ জানত না।’কথাটা কিন্তু হেসে উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। আরাভ খান যে বাংলাদেশে পুলিশ পরিদর্শক হত্যা মামলার আসামি রবিউল ইসলাম সেটি তো এর আগে সেভাবে আলোচনায় আসেনি।
এই যে দেখেন খুন করে তিনি চলে গেলেন ভারতে, আবার দেশেও এসে বেড়িয়ে যান, আবার বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে ভিসা নিয়ে দেশে আসেন, লাইভ করেন অথচ তাঁর কিছু হয় না!আগেই বলেছি এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। দুই দশকের সাংবাদিকতা জীবনে এমন অনেক ঘটনা দেখেছি চলে না। অনিয়ম, দুর্নীতি আর ক্ষমতার অপব্যবহারের এমন ঘটনা কিন্তু দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে যেগুলো দেশের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত ব্যর্থতা ও স্বেচ্ছাচারিতাকে সামনে নিয়ে আসে।
বহুবছর ধরে আমি একটা কথা বলি-দেখেন বড় বড় রাস্তা বা ভবন একটা দেশের উন্নতির একমাত্র কাঠামো নয় বরং একটা দেশের টেকসই উন্নতির প্রধান শর্ত আইনের শাসন বা সুশাসন। প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো যেখানে ব্যক্তির ইচ্ছে নয় বরং নিয়ম কানুনের মধ্যে সবচেয়ে চলে। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বলেন, ব্যাবসা বলেন, তিতাস, ওয়াসা, ভূমিকা বা সরকারি যে কোন সেবা খাত বলেন এই সুশাসন ও প্রতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভয়াবহ অভাব।
এখানে নিয়মের মধ্যে চলে না বহুকিছু। মনে রাখবেন সুশাসন না থাকলে তার শিকার হতে পারেন যে কেউ। দেখেন স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলো। অনেক দেরি হয়েছে কিন্তু এখনো সময় শেষ হয়ে যায়নি। বরং আরো খারাপ পরিস্থিতি যেন না হয় সেজন্য নীতি নির্ধারকসহ সবাইকে বলবো, আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগে চলুন আমরা আমাদের দেশটাকে ঠিক করি। কাল থেকে রোজা শুরু হচ্ছে।
চলুন সংযম পালনের পাশাপাশি দেশের জন্য দোয়া করি যাতে করে আল্লাহ আমাদের নীতি নির্ধারকদের বোধ দেন যাতে করে এই দেশটা সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশটা সুন্দর হয়। মানুষগুলো ভালো থাকে। ভালো থাকে বাংলাদেশ!