শরিফুল হাসান
চলতি বছরের ১ এপ্রিল পবিত্র ওমরাহ পালনের জন্য সৌদি আরবে গেছেন নাজিমউদ্দিন মোশতাক, সাইফুল ইসলাম, মোহাম্মদ হাসান আলী ও মোহাম্মদ রমিজউদ্দিন। ওমরাহ পালন শেষে এক মাসের মধ্যে তাঁদের দেশে ফেরার কথা থাকলেও তাঁরা এখনো ফেরেননি।
এই চারজনকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছে আল সোবহানী ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া চলতি বছরের শুরুতে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ওমরাহ পালনে যাওয়া নজরুল আলম, জসীমউদ্দিন, রায়হান উদ্দিন, হাবিবুর রহমান, আবদুল মান্নান, কামরুল হাসানসহ আরও অনেকেই ফেরেননি।
অভিযোগ আছে, এভাবে গত পাঁচ বছরে হজ ও ওমরাহর নামে অন্তত ৫০ হাজার লোক সৌদি আরবে গিয়ে কাজের জন্য রয়ে গেছেন। পররাষ্ট্র ও ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, এভাবে লোক পাঠানোর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়ে বাংলাদেশের ৩৬টি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সৌদি সরকার। ২০১০ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত এই ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের পাঠানো তিন হাজার ৪২৭ জন হজযাত্রী ফেরেননি। এসব প্রতিষ্ঠানের তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। আল সোবহানী এই তালিকার বাইরে। এই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
ডিএমপির সূত্রে জানা গেছে, গত জুলাই মাসে রাজধানীর ফকিরের পুলের আল সোবহানী ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে ওমরাহর নামে মানব পাচারের অভিযোগ করেন যাত্রাবাড়ীর এক ব্যক্তি। এতে বলা হয়, ওমরাহ ও হজের নামে প্রতিষ্ঠানটি জনপ্রতি চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিয়ে সৌদি আরবে মানব পাচার করছে। এভাবে যাওয়া ব্যক্তিরা সেখানে কোনো কাজ পাননি। এই অভিযোগটির তদন্ত করছেন মতিঝিল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) দুলাল কুণ্ডু। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযোগটির তদন্ত শেষ হলেই অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।’
আল সোবহানী ইন্টারন্যাশনালের হজ, ওমরাহ ও ট্রাভেল এজেন্সির লাইসেন্স আছে। ওমরাহ ও হজের নামে মানব পাচারের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক শাহিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। আসলে আমাদের মালিকের সঙ্গে তাঁর ভাই আজিজ খানের দ্বন্দ্ব আছে। তিনি কিছু কাগজপত্র নিয়ে চলে গেছেন। তিনিই হয়তো পুলিশে এসব অভিযোগ করেছেন।’
তবে আবদুল আজিজ খান বলেছেন, তিনি বছর দুয়েক আগেই ওই প্রতিষ্ঠান ছেড়ে এসেছেন। কোনো কাগজপত্র আনেননি। প্রতিষ্ঠানটি যে মানব পাচার করছে, সেটি তদন্ত করলেই বেরিয়ে আসবে।
৩৬ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: সৌদি কর্তৃপক্ষ ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মানব পাচারের অভিযোগ তুলেছে। এর মধ্যে ঢাকার পল্টনের হাই লিংকস ট্রাভেলস ইন্টারন্যাশনালের ৩৪৩ জন হজযাত্রীর মধ্যে ৩৩৮ জনই ফেরেননি। এ ছাড়া ঢাকার ট্রাভেল স্কাই কানেকশনের ২১৬ জন, আবাবিল ট্রাভেলসের ২১০ জন, ইনসাফ ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ২০৬, সৌদি বাংলা হজ সার্ভিসের ১৮৯, মতিঝিলের মিনি ট্রাভেলস অ্যান্ড ট্যুরসের ১৮৭, ক্যাসকেড ট্রাভেলসের ৯১, সোনিয়ার ৮৮, আল আমিন অ্যাভিয়েশনের ৮৬, আল ফাতিহার ৮৩, রাজন ওভারসীজের ৮৩, এসএইচ ট্রাভেলসের ৭৮, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনালের ৭৪, ট্রিটন ওভারসীজের ৬১, হান্নাহ ট্রাভেলসের ৫২, জানুর ৫২, গোল্ড ট্রাভেলসের ৪৬, সাদমান এয়ার সার্ভিসের ৪১, মুনীরার ৪০, গালফের ২৯, স্বপ্নপুরী ইন্টারন্যাশনালের ২৩, জিকর-ই-কাবার ১৯ এবং আসিফ, বিএমএস, গ্রীন ও সেন্ট্রাল ট্রাভেলসের ১২ জন করে ৪৮ জন ও আল জিয়া এয়ার ইন্টারন্যাশনালের চারজন হজযাত্রী ফেরেননি।
চট্টগ্রামের যোগাযোগ ট্যুরসের ২৯৫ জন, এস বি আগার ২২৩, আল আমানতের ৬০, নিশান ওভারসীজের ৫৩ ও রাহাত ট্রাভেলসের ৪১ জন ফেরেননি। এ ছাড়া দুবার দুটি লাইসেন্সে সিলেটের রাব্বানী ওভারসীজের ২৪১ জন এবং সালাম ট্রেডিংয়ের ১৩ জন হজ করতে গিয়ে ফেরেননি।
মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, মানব পাচারের অভিযোগে এই ৩৬টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হজযাত্রী পাঠানোর ক্ষেত্রে নিষেধজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (হাব) সভাপতি ইব্রাহিম বাহার প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে প্রতিষ্ঠানগুলো হজে পাঠানোর নামে মানব পাচার করেছে, সেগুলোকে সৌদি সরকারই কালো তালিকাভুক্ত করেছে। বাংলাদেশ সরকারও এ ব্যাপারে সতর্ক আছে। এখন সরকারের যাচাই-বাছাই কমিটি সন্দেহভাজনদের আটকে দিচ্ছে। হজে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের কাছে আমাদের অনুরোধ, কালো তালিকাভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানকে টাকা দেবেন না।’
গত বছর ১৯৩ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ: ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ওমরাহ ও হজে পাঠানোর নামে মানব পাচারের অভিযোগ ওঠায় ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ৩০টি বেসরকারি হজ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করেছে সরকার। গত বছর ১৯৩টি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ ওঠে। এর মধ্যে মানব পাচারের অভিযোগ ওঠায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য দুই লাখ টাকা করে আটটি প্রতিষ্ঠানকে পাঁচ কোটি ৮৬ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এ ছাড়া সৌদি সরকারের অভিযোগের ভিত্তিতে ২০টি হজ এজেন্সির লাইসেন্স জরিমানাসহ স্থগিত রাখা হয়েছে। আরও ১৮টির লাইসেন্স স্থগিত করা হলেও এগুলোকে জরিমানা করা হয়নি। আটটিকে জরিমানা, জামানত বাজোয়াপ্তসহ হজ লাইসেন্স বাতিল করা হয়। গুরুতর অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় পাঁচটিকে পাঁচ লাখ এবং অপর পাঁচটিকে চার লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। হজযাত্রীদের অভিযোগের ভিত্তিতে বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরিমানা করা হয়।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হজ অফিসের পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, ‘হজের নামে মানব পাচার বন্ধ করতে সরকার সতর্ক আছে। কোনো প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে জড়িত থাকলে তাদের লাইসেন্স বাতিল ও জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। যাঁরা হজ বা ওমরাহর নামে গিয়ে সৌদি আরবে থাকার চিন্তা করেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, এমনটি করলে আপনারাই বিপদে পড়বেন।’