নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজের ১৬৫ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যত্ অনিশ্চিত

Spread the love


শরিফুল হাসান

মেডিকেল কলেজের পরিচিতিপত্রে দেশের সেরা চিকিত্সা শিক্ষক, আধুনিক সুযোগ-সুবিধা দেখে চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্নে তাঁরা সবাই ভর্তি হয়েছিলেন আশুলিয়ার বেসরকারি নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজে। কিন্তু ভর্তি হয়েই তাঁরা দেখলেন বাস্তবতা ভিন্ন। শিক্ষক নেই, শিক্ষার উপকরণ নেই। এসব কর্তৃপক্ষকে জানিয়েও লাভ হচ্ছে না, বরং উল্টো হামলা-মামলার শিকার হচ্ছেন তাঁরা।বাধ্য হয়ে নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজের তিনটি শিক্ষাবর্ষের ১৬৫ জন শিক্ষার্থী এখন চাইছেন অন্য মেডিকেল কলেজে বদলি হতে। এ জন্য তাঁরা মানববন্ধন, বিক্ষোভসহ নানা প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। আর কেউ যেন লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্রতারিত না হন, সে জন্য সরকারকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন তাঁরা। একাধিক শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ভর্তি হওয়ার সময় আট লাখ টাকা দিয়েছিলেন। এরপর প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কলেজের বেশির ভাগ বিভাগেই শিক্ষক নেই। ঠিকমতো ক্লাস হয় না। হাসপাতালে চিকিত্সক নেই। রোগীও আসে না। এ প্রসঙ্গে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষার্থীরা যেসব কথা বলেছেন, সেগুলো পুরোপুরি যৌক্তিক। মেডিকেল কলেজটিতে সমস্যার অন্ত নেই। যত শিক্ষক থাকা দরকার, তার এক-তৃতীয়াংশও নেই। হাসপাতালে রোগী নেই। শিক্ষকদেরও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। এই পরিবেশে চিকিত্সাশিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন বলে তিনি মন্তব্য করেন।শিক্ষার্থীরা এসব সমস্যা সমাধানের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়। কর্তৃপক্ষ সমস্যার সমাধান না করে ওই সব শিক্ষার্থীকে হুমকি দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৬ জুলাই শিক্ষক, শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সব পক্ষকে নিয়ে বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৫ জুলাই বিনা নোটিশে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে মালিকপক্ষ। অভিযোগ আছে, এর আগের দিন কর্তৃপক্ষের অনুগত কিছু লোক শিক্ষার্থীদের মারধর করে এবং শিক্ষার্থীদের আসামি করে থানায় মামলা দেয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নীতিমালা অগ্রাহ্য করে প্রতিষ্ঠান পরিচালনার দায়ে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে কলেজে ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে গিয়ে স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে আবার ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। এর আগেও বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় স্থগিতাদেশ নিয়ে এসে কিংবা রিট করে তারা কলেজ চালাচ্ছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের চিকিত্সাশিক্ষা শাখার একজন কর্মকর্তা জানান, ২০০৬ সালের ২২ মে কলেজটিকে ছাত্র ভর্তির অনুমতি দেওয়া হয়। তবে ভর্তি কার্যক্রম শুরুর আগেই শিক্ষক নিয়োগ, ২৫০ শয্যার হাসপাতাল চালু, শিক্ষা উপকরণ নিশ্চিত করাসহ বেশ কিছু শর্ত মানতে বলা হয়। কিন্তু শর্তগুলো না মানায় ২০০৭ সালের ১০ মে ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষে এমবিবিএস কোর্সে শিক্ষার্থী ভর্তি সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। পরে ২০০৮ সালের ১২ মার্চ কলেজ কর্তৃপক্ষ দ্রুততম সময়ে শর্ত পূরণের অঙ্গীকার করলে ২৫ মার্চ স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালের ১২ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্তদল কলেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখে, কোনো শর্তই মানা হয়নি। পরে ১৬ সেপ্টেম্বর কলেজের অনুমোদন বাতিল করা হয়। কিন্তু পরে আবার কলেজ কর্তৃপক্ষ হাইকোর্টে গিয়ে ওই আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ আনে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চিকিত্সা শাখার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই হাসপাতালের যে অবকাঠামো, তাতে মানসম্পন্ন চিকিত্সক নিয়োগের সুযোগ ছিল না। প্রতিবেদনে এই কলেজের কার্যক্রম বাতিল করে এখানকার শিক্ষার্থীদের অন্যান্য বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়। কলেজের শিক্ষার্থীরাও এখন সেটাই চাইছেন। ২০০৭-০৮ সালের পরিচিতিপত্রে লেখা হয়েছে, এই কলেজে ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা ছাত্রাবাস, বিশাল গবেষণাগার এবং উচ্চশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এসবের কিছুই নেই। বরং হাসপাতালেই বাড়িঘর বানিয়ে থাকছেন কর্মচারীরা। সরেজমিন দেখা গেছে, অস্ত্রোপচার কক্ষে বৈদ্যুতিক বাতি ছাড়া কিছুই নেই। এনাটমি বিভাগে পর্যাপ্ত অনুবীক্ষণ যন্ত্র নেই। সম্মেলন কক্ষে নির্মাণকাজ চলছে। বড় বড় বাক্স থাকলেও সেগুলোর ভেতরে যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতালে রোগী দেখা যায়নি। জানা গেছে, আগেও রোগী আসত না। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, কেউ পরিদর্শনে এলে কলেজের গাড়ির চালক ও কর্মচারীদের রোগী সাজিয়ে দেখানো হতো। প্রসূতি কক্ষে রোগী বানানো হতো মেয়েদের হোস্টেলের এক কর্মচারীকে। ওই পরিচিতিপত্রে রোগী হিসেবে গাড়িচালক রহিমের ছবিও আছে। শিক্ষার্থীরা জানান, এনাটমি, প্যাথলজি, ফার্মাকোলজি, মেডিসিন ও সার্জারি বিভাগে কোনো স্থায়ী শিক্ষক নেই। এক এক দিন এক একজন এসে ক্লাস নেন। পরিচিতিপত্রে শিক্ষক হিসেবে যাঁদের নাম লেখা আছে, তাঁদের অনেকেই কখনো ক্লাসে আসেননি। এ ছাড়া হাসপাতালে আলাদাভাবে মেডিসিন, সার্জারি, পেডিয়েট্রিক, গাইনি, চোখ ও নাক-কান-গলা বিভাগ নেই। প্রতিটি বিভাগের প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণের অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে অভিযোগ করায় উপমহাব্যবস্থাপনা পরিচালক রাফসান জামান চৌধুরী শতাধিক শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে এ মাসে একটি মামলা করেন। এক ছাত্রীর বাবা ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, অনেকে বাড়ির জায়গা-জমি বিক্রি করে চিকিত্সক হওয়ার স্বপ্নে সন্তানদের এখানে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীরা এসে প্রতারিত হচ্ছেন। এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাইটিংগেল মেডিকেল কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন জামান চৌধুরী বলেন, তাঁদের কলেজে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। শিক্ষক নেই বলে ছাত্রদের যে অভিযোগ, সে ব্যাপারে তিনি বলেন, এ সমস্যা অন্য মেডিকেল কলেজেও আছে। তিনি জানান, বিভিন্ন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তাঁদের কলেজের ব্যাপারে প্রতিবেদন দিয়েছেন। কলেজের অনুমোদন কেন বাতিল করা হয়েছিল? এর উত্তরে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় বাতিল করা হয়েছিল। এর কোনো কার্যকারিতা নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published.