প্রজন্মের পাঠশালা এখন শাহবাগ
শরিফুল হাসান
বাংলাদেশের পাঠশালা এখন শাহবাগ। সদ্য স্কুল যাওয়া শুরু করেছে যে শিশু, স্কুলের দুরন্ত যে কিশোর, কলেজে ভর্তি হওয়া তরুণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী যুবক, মানবদেহের ব্যবচ্ছেদ শিখতে আসা মেডিকেলের শিক্ষার্থী কিংবা জটিল হিসাব-নিকাশের অঙ্ক শেখা প্রকৌশলের ছাত্র সবার পাঠশালা এখন শাহবাগ। এ পাঠশালায় ভর্তি হতে কোনো জটিলতা নেই। দরকার কেবল দেশপ্রেম আর প্রবল ইচ্ছা। আর সেটি আছে বলেই স্কুল-কলেজের পোশাক পরা বিভিন্ন স্কুলের হাজার হাজার ছাত্রের পদচারণে এখন মুখর শাহবাগের পাঠশালা।কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজার রায় প্রত্যাখ্যান করে গত মঙ্গলবার বিকেলে শাহবাগ মোড়ে জড়ো হয় জনতা। এরপর শাহবাগের ‘প্রজন্ম চত্বর’-এ তৈরি হয় নবজাগরণ মঞ্চ। ছয় দিন ধরে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। কিন্তু কয়েক দিন ধরেই শাহবাগ মাতিয়ে রেখেছেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শাহবাগের বিভিন্ন স্থানে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে তাঁরা কেউ দেশের গান গাইছেন। কেউ স্লোগান দিচ্ছেন। কেউ আবার পোস্টার লিখে বিলিয়ে দিচ্ছেন জনতার মধ্যে। হলিক্রস কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের কয়েক শ ছাত্রী কলেজের পোশাক পরেই এসেছিল শাহবাগে। ইতিমধ্যেই তারা বর্ণমালা শিখে গেছে। তাই কলেজের ছাত্রী নাহিদা যখন স্লোগান দিচ্ছিল ‘ক-তে কাদের মোল্লা’। তখন বাকিরা বলে যাচ্ছিলেন ‘তুই রাজাকার, তুই রাজাকার’। ভিকারুননিসার ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রী ফারিয়া নাজনীনও রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে এসেছিল শাহবাগে। তার বোন একই কলেজে উচ্চমাধ্যমিকে পড়ে। বোনের সঙ্গে সেও এসেছিল এখানে। বেলা দুইটার দিকে বিভাগের শিক্ষকদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের কয়েক শ শিক্ষার্থী যোগ দেন শাহবাগের আন্দোলনে। বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এ সময় প্রথম আলোকে বলেন, ‘শাহবাগে তারুণ্যের এ জাগরণ অভূতপূর্ব।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের একদল শিক্ষার্থী বেলা সাড়ে তিনটার দিকে ব্যানার আর মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের স্লোগান নিয়ে যোগ দেন শাহবাগে। বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী তাহমিনা আক্তার বলেন, যারা এ দেশটার জন্মই চায়নি, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা দ্বিতীয় দিন থেকেই আছে এই আন্দোলনে। ওই কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্রী আরবি আক্তার, আইরিন আক্তার, তাসফিয়া তাহসিন, নাজনীনসহ আরও অনেকে বলল, এই বাংলাদেশের শেষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে প্রস্তুত। সরকারি বিজ্ঞান কলেজের দুই থেকে তিন শ ছাত্র এক সারিতে সাদা শার্ট পরে বিকেলে এসে যোগ দেয় শাহবাগে। ফখরুল, অভি, মমিনসহ আরও অনেকেই জানাল, ক্লাস শেষ করেই তারা এখানে চলে এসেছে। কাকলী উচ্চবিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী সেঁজুতি, সালমা, লাভলী ও সুমি সমস্বরে জানায়, রাজাকারদের ফাঁসি চাইতে তারা এখানে এসেছে।জাদুঘরের সামনে গোল হয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শ খানেক শিক্ষার্থী। শিমন মাহমুদ, এম আহমেদ, মিশো চৌধুরী, শুভ সাহা, আদৃতা ইসলাম, সাহিলা, তাজবিনা ও নূর জানালেন, রাজাকারদের ফাঁসি দিয়ে তাঁরা দেশকে কলঙ্কমুক্ত করতে চান। চারুকলার একদল শিক্ষার্থী ফাঁসির দাবির নানা পোস্টার আর ব্যঙ্গচিত্র নিয়ে গোল হয়ে বসেছিলেন জাদুঘরের সামনে। আইরিন আক্তার, শারমিন, শুভ, মামুনম রাকিব, ফয়সাল জানালেন, বাংলাদেশের তরুণরা এই দেশে কোনো রাজাকারকে, একাত্তরের কোনো খুনিকে দেখতে চায় না।