টাকার বিনিময়ে হকারদের ফুটপাত বরাদ্দ

Spread the love

আদালতের নিষেধ মানল না ডিসিসি

শরিফুল হাসান


আদালতের নিষেধাজ্ঞা, পুলিশের অভিযান— কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে শেষ পর্যন্ত হকারদের কাছেই কাগজে-কলমে ফুটপাত বরাদ্দ দিল ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি)। পুরো প্রক্রিয়া শেষ করা হয়েছে অতি গোপনে। এক সপ্তাহ ধরে হকাররা ডিসিসির চালানে ফুটপাত বরাদ্দের জন্য প্রতি বর্গফুট ১০ টাকা হারে টাকাও শোধ করছেন।এই অনুমোদনের ফলে এখন থেকে হকাররা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করতে পারবেন। তাঁরা ফুটপাতের ওপর অস্থায়ী দোকানও বানাতে পারবেন। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অনিক আর হক প্রথম আলোকে বলেন, আদালত সম্প্রতি ওই এলাকার ফুটপাত বরাদ্দ না দেওয়ার জন্য ডিসিসিকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি ওই মামলার আইনজীবী ছিলেন। কাজেই আদালতের নির্দেশ না মেনে ডিসিসি যদি ফুটপাত বরাদ্দ দেয়, তাহলে সেটি আদালত অবমাননা হবে। তাঁরা প্রয়োজনে আদালত অবমাননার মামলা করবেন।ডিসিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতি বর্গফুট ফুটপাতের জন্য ডিসিসি ১০ টাকা করে পাবে। সেই হিসাবে তিন হাজার ৭০০ বর্গফুটের জন্য ডিসিসি পাবে মাত্র ৩৭ হাজার টাকা। তবে পুলিশ ও হকাররা বলছেন, এই বরাদ্দ-বাণিজ্যের পেছনে কয়েক কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলে একটি চক্র একেকজন হকারের কাছ থেকেই নিয়েছে দেড় লাখ টাকা। এই টাকার একটি বড় অংশই গেছে ডিসিসিতে।অনুসন্ধানে জানা গেছে, হকার্স সমিতির নেতাদের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী নিউমার্কেট ও গাউছিয়া এলাকার মোট তিন হাজার ৭০০ বর্গফুট ফুটপাত বরাদ্দ দিয়েছে ডিসিসি। মোট ২২২ জন হকার এই বরাদ্দ পেয়েছেন। মেয়র সাদেক হোসেনের অনুমোদনেই এই বরাদ্দ দেওয়া হয়।গত ১২ মার্চ মেয়র প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গত বৃহস্পতিবার এ ব্যাপারে আবার মন্তব্য জানতে চাইলে একই কথা বলেন তিনি। আপনার স্বাক্ষরে এই অনুমোদন হয়েছে—এমন কথা বলার পর মেয়র বলেন, এটি হওয়ার কথা নয়। এমন কোনো অনুমোদন তিনি দেননি।অনুসন্ধানে জানা গেছে, মেয়র অনুমোদন দিলেও হকার্স সমিতি, ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা এবং ওই এলাকার পুলিশের তালিকাভুক্ত কয়েকজন সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত।পুলিশ বিষয়টি ঊর্ধ্বতন মহলকে জানিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, কোনো অনুমতি না থাকার পরও হকাররা ফুটপাত দখল করে ব্যবসা করেন। তাঁদের উচ্ছেদ করা যায় না। আর এখন কাগজে-কলমে বরাদ্দ দিলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে।ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার এ কে এম শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ডিসিসিকে বারবার বলা হয়েছে, মানুষের দুর্ভোগ বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয় এমন কোনো জায়গায় যেন কোনোভাবেই বরাদ্দ না দেওয়া হয়। কিন্তু কিছু লোক ফুটপাত বরাদ্দ নেওয়ার জন্য অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছে। এভাবে ফুটপাত বরাদ্দ দিলে মানুষের চরম দুর্ভোগ হবে। বিষয়টি নিয়ে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হবে।২০০১ সালের এপ্রিলে হাইকোর্ট ফুটপাত হকারমুক্ত করতে সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেন। তিন মাস অন্তর এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতেও বলা হয়। কিন্তু ডিসিসি সে নির্দেশ মানেনি। এ বছর ডিসিসি আবার ফুটপাত বরাদ্দ প্রক্রিয়া শুরু করলে ফুটপাত বরাদ্দ বন্ধের নির্দেশ চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট করেন নিউমার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি জহিরউদ্দিন। ২৪ ফেব্রুয়ারি আদালত ডিসিসিকে ওই এলাকার ফুটপাত বরাদ্দ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু এর পরও ডিসিসি ফুটপাত বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছে।যেভাবে চলে পুরো প্রক্রিয়া: অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই এলাকার ফুটপাত স্থায়ীভাবে বরাদ্দ নেওয়ার জন্য একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছিল। সব প্রক্রিয়া শেষ করে ২০০৯ সালের ৩০ নভেম্বর ডিসিসিকে চিঠি দেন গাউছিয়া-নিউমার্কেট হকার্স ঐক্য পরিষদের সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক ছাত্তার মোল্লা। চিঠিতে তাঁরা নিউমার্কেটের বাইরে দক্ষিণ ও পূর্বপাশের দেয়ালসংলগ্ন এবং গাউছিয়া মার্কেটের পশ্চিম পাশের খালি জায়গা মাসিক টোলের ভিত্তিতে বরাদ্দ চান। চিঠির সঙ্গে ২২২ জন হকারের একটি তালিকাও দেওয়া হয়।এরপর ডিসিসির জরিপকারী ওই এলাকা জরিপ করে সরেজমিন প্রতিবদেন দেন। এতে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরে হকাররা ওই এলাকায় রোদে-বৃষ্টিতে ভিজে ব্যবসা করেছেন। এরপর কয়েকটি চিঠি চালাচালি শেষে সর্বশেষ মেয়র সাদেক হোসেন ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে ১২ মার্চ ‘ঢাকায় ফুটপাত বরাদ্দ-বাণিজ্য’ শিরোনামে প্রথম আলোয় একটি সংবাদ প্রকাশিত হলে পুরো প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহে হকাররা আবার সক্রিয় হলে ডিসিসির কর্মকর্তারা ১০০ টাকার স্ট্যাম্পে হকারদের অঙ্গীকারনামা নেন।অঙ্গীকারনামায় সাতটি শর্তের কথা বলা আছে। এর মধ্যে রয়েছে প্রতি বর্গফুট মাসিক ১০ টাকা হারে বর্ণিত জায়গার মাসিক ভাড়া ২৪০ টাকা প্রতি মাসের ৭ তারিখের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। জায়গার মালিকানা দাবি করা যাবে না। সম্পূর্ণ অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হলো। কোনো রকম অবৈধ কার্যক্রম করা যাবে না। স্থায়ী ঘর নির্মাণ করা যাবে না, তবে অস্থায়ী শেড নির্মাণ করা যাবে। নিজ দায়িত্বে হকারদের বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে হবে।অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরের পর ইতিমধ্যে হকারদের কাছ থেকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসের ভাড়া নিয়েছে ডিসিসি। ডিসিসির চালানে টাকা জমা দেওয়ার রসিদও প্রথম আলোর কাছে আছে।ডিসিসি কেন এভাবে ফুটপাত বরাদ্দ দিল জানতে চাইলে এক কর্মকর্তা বলেন, হকাররা অনেক কান্নাকাটি করেছেন। তাঁদের কাছ থেকে পুলিশসহ বিভিন্ন মহল চাঁদা নেয়। এতে ডিসিসির কোনো লাভ হয় না। বরাদ্দ দিলে ডিসিসির অন্তত কিছু টাকা আসবে।কোটি টাকার বাণিজ্য: স্থানীয় হকাররা জানিয়েছেন, গাউছিয়ার সামনে সাড়ে তিন বাই চার—এই হিসাবে ১৪ বর্গফুট করে প্রত্যেককে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। নিউমার্কেট এলাকার হকাররা আট বাই তিন হিসাবে ২৪ বর্গফুট জায়গা পাচ্ছেন। এভাবে মোট ২২২ জন হকার বরাদ্দ পাবেন। তবে যে যেখানেই ব্যবসা করছেন, তিনি সেখানেই অগ্রাধিকার পাবেন।গোয়েন্দা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ বর্গফুটের একটি জায়গার জন্য ডিসিসি পাচ্ছে ২৪০ টাকা। কিন্তু ওই স্থান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য প্রত্যেক হকারের কাছ থেকে এক লাখ ৪০ হাজার টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এভাবে ওই এলাকার ফুটপাত বরাদ্দ বাবদ তিন কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। হকার্স সমিতির নেতা, স্থানীয় কয়েকজন সন্ত্রাসী ও ডিসিসির কয়েকজন কর্মকর্তা এই টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন।গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গাউছিয়া এলাকার হকার্স সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন, সাধারণ সম্পাদক সাত্তার, নিউমার্কেট কাঁচাবাজার সমিতির নেতা ও ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোখলেস, ৫২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের চুন্নু, দুলাল ও নেছার এবং স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা কালা বাবু এর সঙ্গে জড়িত। কালা বাবু নিউমার্কেট থানার তিন নম্বর তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী।গাউছিয়া এলাকার হকার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাত্তার মোল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটি সত্যি, আমরা ফুটপাত বরাদ্দ নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু এখন আমার কথা কেউ শুনছে না। আমি এই প্রক্রিয়ায় নেই। কিন্তু সবাই মনে করছে, আমি এখন নিউজ করাচ্ছি। আসলে আমি কিছুই জানি না।’নিউমার্কেট-গাউছিয়া এলাকার হকার্স সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হোসেন টাকা নেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, হকারদের যে যখন পারে তুলে দেয়। তাই তাঁরা স্থায়ী কিছু করার চেষ্টা করেছিলেন। দেড় লাখ টাকা করে নেওয়ার অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো কথা বলেননি।ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা মোখলেস বলেন, তিনি এই প্রক্রিয়ায় নেই। তবে তাঁর কয়েকজন আত্মীয় ওই এলাকার ফুটপাতে ব্যবসা করেন। তিনি তাঁদের বিষয়টি দেখভাল করতে গিয়েছিলেন।নিউমার্কেট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ এম কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এভাবে কোন আইনে ফুটপাত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে? ফুটপাতে হকাররা স্থায়ীভাবে বসলে ভয়াবহ সমস্যা হবে। ফুটপাত নিয়ে এখন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য হচ্ছে। এভাবে চললে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হবে। আপনারা কেন বাধা দিচ্ছেন না জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘আমরা কি ডিসিসির সঙ্গে মারামারি করব?’

Leave a Reply

Your email address will not be published.