শরিফুল হাসান
২০১৭ সালের আজকের দিনে আমার একযুগের কর্মস্থল, ভালোবাসার প্রতিষ্ঠান প্রথম আলো ছেড়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন পোগ্রাম হেড হিসেবে যোগ দিয়েছিলাম। ১৬ জুলাই, ২০১৭ থেকে ১৬ জুলাই ২০২২।
দেখতে দেখতে পাঁচ পেরিয়ে আজ ছয় বছরে পদার্পন। অথচ মনে হয় এই তো সেদিন ছাড়লাম প্রথম আলো। কেমন ছিল গত পাঁচ বছরের জীবনটা? ব্র্যাকে যোগ দেওয়ার সময় বলেছিলাম, প্রবাসীদের জন্য কাজ করতে চাই। তরুণদের পাশে দাড়ানোর কাজটাও অব্যাহত রাখতে চাই। সবার কাছে দোয়া চেয়েছিলাম, যাতে আমার আদর্শ, সততা, স্বকীয়তা, আর মানবতার শক্তিতে বলীয়ান হয়ে কাজ করতে পারি।
গত পাঁচ বছরে কতোটা পেরেছি সেই বিশ্লেষণ আপনারা করবেন। আমি শুধু চেষ্টা করেছি মানুষের দুঃখে আমার পুরো টীম নিয়ে পাশে থাকতে। শুনলে আপনাদের হয়তো ভালো লাগবে, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দের সরকারি সব দপ্তরের সহযোগিতায় গত পাঁচ বছরে বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক, আর্মড পুলিশসহ, সিভিল এভিয়েশনসহ সবার সহযোগিতায় আমরা প্রায় ২৬ হজার বিদেশফরেত মানুষকে খাবার, পানি, বাড়ি পৌঁছে দেয়া, অর্থসহ নানা জরুরী সহায়তা দিতে পেরেছি।
আমরা আসলে প্রবাসীদের মনে এই ভরসা দিতে চেয়েছি যে আপনাদের পাশে আছি। আইওম বাদে এর আগে কোন বেসরকারি সংস্থা বিমানবন্দরে এই কাজগুলো কেউ কেউ করেনি। ঢাকার পর চট্রগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও আমরা গত দুই বছর ধরে একই কাজ অব্যাহত রেখেছি। শুধু জরুরি সহায়তা নয়, বিদেশ ফেরত মানুষগুলো যেন ফের জীবন জীবিকায় শুরু করতে পারেন সেজন্য গত পাঁচ বছরে প্রায় দশ হাজার বিদেশফেরতকে নানা ধরনের দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছি।
প্রায় তিন হাজার বিদেশ ফেরত মানুষ আমাদের অর্থ সহায়তায় উদ্যোক্তা হিসেবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় তিনশ’আছেন নারী। কোভিডকাল এবং পরে আমরা সাত হাজারেরও বেশি প্রবাসীকে তিন কোটি টাকার ও বেশি জরুরী অর্থ সহায়তা দিতে পেরেছি। বিদেশফেরতদের মানিসক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে আমরাই প্রথম জোর দিয়েছি। আমাদের ১৮ জন সাইকোসোসাল কাউন্সিলর প্রায় পাঁচ হাজার নারী-পুরূষকে সাইকোসোসাল কাউন্সিলিং দিতে পেরেছি যেটা বিদেশফেরতদের মানসিকভাবে শক্তি জুগিয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের এনপিইউ বিশেষ করে অধ্যাপক কামাল স্যার আমাদের কাউন্সিলিং টিমের পেশাগত দক্ষতার উন্নয়নের পাশাপাশি মান সম্পন্ন সেবা কিভাবে দেওয়া যায় সেই সম্পর্কে নিয়মিত দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। মানসিক স্বাস্থ্যের এই বিষয়টি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে।
পরিসংখ্যানের ভার দিয়ে কাউকে বিরক্ত করতে চাই না। পাঁচ বছর পর বিনয়ের সাথে শুধু এটুকু বলতে পারি, সাংবাদিক হিসেবে, টানা একযুগ যেমন অভিবাসন খাতের নানা বিষয়ে রিপোর্টিং করেছি তেমনি ব্র্যাকে যোগ দিয়ে চেষ্টা করেছি সরাসরি এই মানুষগুলোর সেবা করার। ওপরওয়ালাকে ধন্যবাদ তিনি সেই সুযোগ দিয়েছেন।
আজও মনে আছে, প্রথম আলো ছেড়ে ব্র্যাকে আসবো কী না তা নিয়ে নিজেই খুব দ্বিধায় ছিলাম। চূড়ান্ত ভাইভার দিনে আমি বরং আসিফ ভাইকে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন আমি ব্র্যাকে আসবো দ্বিধায় অছি। আসিফ ভাই সেদিন বলেছিলেন, সারাজীবন সাংবাদিকতা করেছেন। মানুষের ভালোবাসা পেয়েছেন। আপনার অনেক নিউজে অনেক কাজ হয়েছে কিন্তু সরাসরি মানুষের জন্য কিন্তু করতে পারেননি।
ব্র্যাকে এলে সরাসরি মানুষের পাঁশে দাঁড়াতে পারবেন। আর আপনার লেখালেখি তো চালিয়ে যেতে পারবেনই। এই যে মানুষের পাশে সরাসরি দাঁড়াতে পারবো এই কয়েকটা কথাই আমার জীবনের বাক বদলে দেয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সৃষ্টিকর্তা সারাজীবন বিশেষ করে গত চার বছরে মানুষের পাঁশে সরাসরি দাঁড়ানোর যে সুযোগ দিয়েছে, তাতে মনে হয়, মানুষ হিসেবে জীবনটা মিছে নয়। আসিফ ভাইসহ ব্র্যাকের ম্যানেজমেন্টকে বিশেষ ধন্যবাদ। কখনো তারা আমার কোন ভালো কাজে না বলেনি।
কাজের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছেন। ব্র্যাকে যোগ দেয়ার কয়েক মাস পর ঘটনাচক্রে ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গে এক ঘন্টার একটা আলাপ হয় তার কক্ষে। সেই আলাপই আমাকে নতুন শক্তি দিয়েছিল। সেই গল্প আলাদা করে লিখেছি। আবেদ ভাই আজ নেই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। সবচেয়ে বেশি ধন্যবাদ দিতে হয় আমার ভালোবাসার মাইগ্রেশন টীমের সব সদস্যকে।
ঢাকায়,ঢাকার বাইরের জেলা, উপজেলার সহকর্মী এমনকি ইউনিয়নের সেই স্বেচ্ছাসেবককেও। এই হাজার দেড়েক মানুষের প্রত্যেককে কৃতজ্ঞতা। অসাধারণ একটা টীম আমাদের মাইগ্রেশন টীম। এটা আমার আরেকটা বড় পরিবার। টীমকে যখন যেই সময় বলেছি, এমনকি গভীর রাতেও এয়ারপোর্টে যেতে হবে, মানুষের কাছে যেতে হবে তারা কখনো না করেননি। এই দেশের হাজারো বিদেশফেরত বা বিদেশগামী মানুষের জীবন বদলানোর সত্যিকােরর নায়ক এই টীমের সদস্যরা।
আমি সাংবাদিকতার মানুষ, কতো কিছু জানি না, এই টিম আমাকে হাতে ধরে ধরে শিখেয়েছ। আজও শিখি। এমন এমন অসাধারণ টীম না পেলে আমার গত চার বছর এতো স্বস্তির হতো না। আমি সবসময় বলি স্বপ্ন দেখতে হবে আকাশ ছোঁয়ার আর বিনয়ে চোখ থাকবে মাটিতে। আমাদের টিমটাও তাই হয়েছে।
মানুষের সাথে সর্বোচ্চ ভালো ব্যবহার করা জানে আমাদের টিম। এ কারণেই ব্র্যাকের গাড়িচালক থেকে শুরু করে সাধারণ অনেক কর্মী মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সাথে কাজ করবে শুনলে অনেক খুশি হন। শুধু মাইগ্রেশন টিম নয়, ধন্যবাদ ব্র্যাকের নানা বিভাগের সবাইকে নানাভাবে সহায়তার জন্য। এই বছরের মার্চ থেকে ব্র্যাকের ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভসের দায়িত্ব কাঁধে পড়েছে। এই দেশের তরুণদের জন্য অর্থবহ কিছু করার চেষ্টা করবো। আমাদের ইয়ুথ টিমের সবার জন্য ভালোবাসা।
আসলে ব্র্যাকে গত পাঁচ বছর কাজ না করলে প্রতিষ্ঠান কী জিনিষ আমার জানা হতো না। আফসোস এই দেশে সবকিছু ব্যক্তি কেন্দ্রিক, আমরা প্রতিষ্ঠান গড়ি না। ব্র্যাককে আমার মনে হয়েছে সত্যিকারের একটা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ ধন্যবাদ দিতে চাই প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে। গত পাঁচ বছরে সবসময় তাদের সহযোগিতা পেয়েছি। তবে বর্তমান সরকারের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহেমদ স্যারকে বিশেষ ধন্যবাদ। সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের বর্তমান সচিব সালেহীন স্যারকে বিশেষ ধন্যবাদ। সত্যিকারের একজন শিক্ষকের ছেলে সালেহীন স্যারের একটা অসাধারণ মানবিক মন রয়েছে। তিনি এই খাতের সবাইকে নানাভাবে গাইড করেন।
বিএমইটির সাবেক মহাপরিচালক ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব সেলিম রেজা স্যার, সাবেক মহাপরিচালক শামসুল আলম স্যার আর বর্তমান মহাপরিচালক শহীদুল আলম স্যার ধন্যবাদ সেখানকার সব সৎ কর্মকর্তাদের। বর্তমান মহাপরিচালক শহীদুল স্যারকে চিনি আরও প্রায় বছর দশেক আগে থেকে তিনি যখন বরিশালের ডিসি। সাংবাদিকতার সূত্রেই ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালকসহ পুরো টীমকে বিশেষ ধন্যবাদ সবসময় সহায়তা করার জন্য। গত পাঁচ বছরে দারুণ সহযোগিতা পেয়েছি তাদের কাছ থেকে।
ধন্যবাদ এয়ারেপাের্টের ওয়েলফেয়ার ডেস্ককে, সেখানকার সহকারী পরিচালক ফখরুল আলমকে যার মাথায় সবসময় কাজ থাকে। পুলিশের এপিবিএনের প্রত্যেকটা মানুষকে ধন্যবাদ। বিশেষ ধন্যবাদ সিভিল এভিয়েশনের কর্মকর্তাদের। সিআইডিসহ বাকিদের ধন্যবাদ যারা নানা ঘটনা তদন্তে সবসময় পাশে ছিলেন। ধন্যবাদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে। আইওম, আইএলওসহ দেশি-বিদেশি নানা সংস্থাকে ধন্যবাদ।
আপনাদের কাছ থেকে শিখেছি অনেক কিছু। ধন্যবাদ সব মানবিক মানুষকে যারা গত পাঁচ বছরে পাশে ছিলেন। সত্যি বলছি, গত পাঁচ বছর কীভাবে কেটেছে টের পাইনি। কখন খেয়েছি, কখন ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। প্রথম আলো ছাড়ার সময় ভেবেছিলাম নিজের বাচ্চাটাকে আরেকটু বেশি সময় দিতে পারবো। ভেবেছিলাম রিপোর্টিং যখন ছেড়েছি, নয়টা পাঁচটার জীবনে ফিরতে পারবো। কিন্তু হয়েছে উল্টোটা। এখন আর কাজের কোন ঘন্টা নেই। কতোদিন যে পুরো টীম টীম নিয়ে এয়ারপোর্টে মশার কামড় খেয়েছি, এপিবিএন সদস্যদের সাথে কথা বলে বলে রাত ভোর করেছি ওপরওয়ালাই জানেন। গত পাঁচ বছরে আমার মোটামুটি ধ্যান জ্ঞান ছিলো ব্র্যাক।
এর মধ্যেও প্রায় তিন বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে উন্নয়ন যোগাযোগ কোর্সটা পড়িয়েছি খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে। সেই অভিজ্ঞতাও ছিলো দারুণ। ছেলেমেয়েরা সবসময় যে আনন্দ নিয়ে শিখতে চায় আমার সেই বিশ্বাসটা আরো তীব্র হয়েছে। জাহাঙ্গীরনগরের পর এখন স্টেট ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েদেরও উন্নয়ন যোগাযোগ কোর্সটা পড়ানোর চেষ্টা করেছি। এখানেও অভিজ্ঞতা ইতিবাচক। নিজের কাজের পাশাপাশি গত পাঁচ বছরে মানুষের কথা শোনার চেষ্টা করেছি সবসময়।
সামনাসামনি, ফেসবুকে, হোয়াটসঅ্যাপে কতো যে মানুষের কথা শুনেছি। সমাধান কতোটা পেরেছি জানি না কিন্তু চেষ্টা করেছি। আমার সবচেয়ে আনন্দের জায়গা লেখালেখি। গত পাঁচ বছরে সময় সুযোগে কলাম লেখার পাশাপাশি ডেইলি স্টারে ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে মাঝে মধ্যে রিপোর্টিং করছি। এজন্য ডেইলি স্টারের আশফাক ভাইকে বিশেষ ধন্যবাদ। আজকের পত্রিকায় নিয়মিত না পারলেও মাঝে মধ্যে লিখেছি।
জাহিদ ভাই, সেলিম ভাই, কামরুলকে ধন্যবাদ যে তারা কখনো উৎসাহ দিয়েছেন কখনো তাগাদা। শুধু গণমাধ্যমে নয় ফেসবুকও আমার লেখার একটা বড় জায়গা ছিল। যানজটে বসে লিখেছি, লিখেছি গাড়িতে চলতে চলতে। এই যে এক লাখ ৩২ হাজার মানুষ আমাকে ফলো করেন, আমার লেখা পড়েন সেটা আমার জন্য একটা বড় শক্তি।কিন্তু কথা হলো সারাদিন কাজ করে আমি লিখবো কখন? ছুটির দিনগুলোতেও কাজের চাপ থাকতো। ফলে বাচ্চাটা ঘুমিয়ে পড়লে বহুদিন রাতে ২ টা-৩ টায় লিখতে বসেছি।
পরিবারকে সময় দিতে পারিনি বললেই চলে। এই যে একদিকে সারাদিন কাজ, গভীর রাতে উঠে লেখা বা নিজের পড়া তাতে কখনো কখনো কোন কোন দিন ৪-৫ ঘন্টা ঘুমিয়েছি। দিনভর শত শত ফোন, ইনবক্সে রোজ হাজারো বার্তা সব মিলিয়ে মাঝে মধ্যে মনে হয় দিনটা ২৪ ঘন্টায় না হয়ে ৪৮ ঘন্টায় যদি হতো! এতো কষ্টের পরেও একটাই আনন্দ ছিলো এই জীবনে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টাটা অন্তত করতে পারছি। এর চেয়ে বড় আনন্দ আমার আর কিছু ছিল না।
তবে এরপরও বারবার শিন্ডলার্স লিস্ট সিনেমার শেষ দৃশ্যের মতো মনে হয়, আরো কিছু মানুষের জন্য কিছু যদি করা যেত! যাই হোক, আপনাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞতা। যারা সহযোগিতা করেছেন তারা তো বটেই আবার সেই মানুষগুলোর কাছে কৃতজ্ঞতা যারা নানাভাবে বাঁধা দিয়েছেন। আপনারা বাঁধা দিয়েছেন বলেই আমার নতুন শক্তিতে কাজ করতে ইচ্ছে করেছে। আর যারা সহযোগিতা করেছেন তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা বারবার। আপনারা সবসময় দোয়া করবেন যেন ছয় বছরের যে শুরুটা হলো সেটা যেন অর্থবহ করতে পারি। আমি এই বাংলাদেশকে ভীষণ ভালোবাসি।
আমি দেশের জন্য মানুষের জন্য চেষ্টা করতে চাই। আমার কাজে কোন ভুল হলে ক্ষমা করবেন। শুধরে দেবেন। দোয়া করবেন যেন যেন মানুষ হয়ে মানুষের জন্য বাঁচতে পারি, মরতে পারি সত্যিকারের মানুষ হয়ে। কৃতজ্ঞতা ও ভালোবাস সবাইকে