ঘামঝরা জীবন, রক্তে ভিজে শেষ

Spread the love

শরিফুল হাসান


মা রাবেয়া খাতুন গত তিন বছর মাথায় নারকেল তেল দেন না। সামান্য সেই নারকেল তেলের পয়সাও তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় ছেলের জন্য। ছেলে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। খরচ তো কম না!বাবা দিনমজুরি আর ভাই মুদি দোকান করে সংসার চালিয়ে যা থাকে, তার সঙ্গে যুক্ত করতে হয় মায়ের মুরগির ডিম বিক্রির টাকাও। তাতেও চলতে পারতেন না ইসলামের ইতিহাসে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আবু বকর। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময় নিজে গ্রামে গিয়ে রোজগারের চেষ্টা করতেন। কারও কৃষিখেতে কাজ করে, কারও বাচ্চাকে পড়া দেখিয়ে দিয়ে নিজের পড়ার খরচ জোগাতে হতো তাঁকে।স্বপ্নের ছায়ায় অনটনের আগুন নেভাতে চেয়েছিলেন আবু বকর। ‘আর একটা বছর তোমরা কষ্ট কর। আমি পাস করে বের হলে ভালো চাকরি হবে। তোমাদের আর এত কষ্ট করতে হবে না।’ গত ডিসেম্বরে কোরবানির ঈদে বাড়িতে গেলে ছোট ভাই ওমর ফারুককে নিজের স্বপ্নের কথা বলে এভাবে আশ্বস্ত করেছিলেন আবু বকর সিদ্দিক। দশম শ্রেণীর ছাত্র ফারুকের কান্না তাই বাঁধ মানে না। ‘আমার ভাই তো কোনো দল করত না। মারামারি করতেও যায় নাই। তার পরও কেন তাকে মরতে হলো?’গতকাল বুধবার সকালে খবর আসে আবু বকর মারা গেছেন। ছেলের মৃত্যুর খবর শুনে মা রাবেয়া বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। চেতনা ফিরলেই বিলাপ, ‘আমার বাবা কনে চইলা গেল, বাবারে আইনা দেও।’ টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার গোলাবাড়ী গ্রামের দিনমজুর রোস্তম আলীর তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মধ্যে আবু বকর তৃতীয়। গতকাল দুপুরে গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির সামনে কবর খোঁড়া হচ্ছে। বাড়িজুড়ে দারিদ্র্যের ছাপ। ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়ার দুটি ঘর। এক ঘরে কোরআন পাঠ হচ্ছে। অন্য ঘরে বাবা-মাসহ স্বজনেরা কান্নাকাটি করছে। গ্রামের লোকজন সব জড়ো হয়েছে বাড়িতে।বাবা রোস্তম আলী বলেন, ‘আমি দিনমজুর মানুষ। বড় ছেলে আব্বাস আলী গোলাবাড়ী বাজারে ছোট একটি মুদির দোকান করে। ছেলের মা মুরগি পালন ও ডিম বিক্রি করে টাকা দিত বকরকে। তার পরও খরচ কুলাত না। তাই বন্ধের সময় বাড়িতে এসে বকরও খেত-খামারে দিনমজুরি করত।’গোলাবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক আবদুল লতিফ জানান, ২০০৪ সালে তাঁর স্কুল থেকে আবু বকর এসএসসি পাস করে মধুপুর শহীদ স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বিজ্ঞান বিভাগে পড়তে খরচ বেশি, তাই মেধাবী আবু বকর মানবিক বিভাগে লেখাপড়া করেন। প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম জানান, স্কুল-কলেজে পড়ার খরচও আবু বকর দিনমজুরি করে জোগাড় করেছেন।প্রতিবেশী শহীদুল ইসলাম জানান, ‘গোলাবাড়ী গ্রামের মধ্যে আবু বকরই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সে বাড়িতে এলে গ্রামের ভালো ছাত্রদেরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য নানা পরামর্শ দিত।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে তৃতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষায় আবু বকর জিপিএ-৪-এর মধ্যে ৩.৭৫ পেয়েছিলেন। এই বিভাগে গত কয়েক বছরে এমন ফলাফল কেউ করেননি। তাঁর চতুর্থ সেমিস্টারের ফল এখনো প্রকাশ হয়নি। এই সেমিস্টারে প্রথম হলে আবু বকরই বিভাগে তাঁর ব্যাচে শীর্ষে থাকতেন।আবু বকরের কথা স্মরণ করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নুসরাত ফাতেমা। ‘আমরা ওকে নিয়ে প্রচণ্ড আশাবাদী ছিলাম। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। কে এর জবাব দেবে?’এফ রহমান হলের ৪০৪ নম্বর কক্ষে থাকতেন আবু বকর। একই কক্ষে থাকতেন তাঁর বন্ধু ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাহবুবুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত ভদ্র, নিরীহ ও বিনয়ী ছেলে খুব কম দেখেছি। ও অনেক গরিব। ও বলত, পরিবারের হাল ধরবে ও। বলত, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে। মিরপুরে একটা টিউশনি করত। কিন্তু ব্যাচে প্রথম হওয়ার জন্য সেটিও ছেড়ে দিয়েছিল। শুধু যুক্ত ছিল বাঁধনের (স্বেচ্ছা রক্তদানকারী সংগঠন) সঙ্গে।’বন্ধুদের কাছে আবু বকরের একটি নোটখাতা পাওয়া গেছে। রক্তে ভেজা। সেই খাতায় ছয়টি প্রশ্নের উত্তর লেখা। এরপর লেখা শুধু ‘প্রশ্ন:’।কী ছিল সেই প্রশ্ন? তার উত্তরই বা হতো কী, তা আর জানা যাবে না কখনোই। প্রশ্ন আবু বকরের বাবারও, ‘আবু বকর আমাগো এক প্রদীপ আছিল। হেই প্রদীপ নিভা গেল। এহন আমগো সামনে অন্ধকার। কে দেখব আমাগো?’

Leave a Reply

Your email address will not be published.