শরিফুল হাসান

চলে গেল ছোট্ট চন্দ্রমুখী। মা মানতে পারলেন না। চন্দ্রের কাছে চলে যেতে চাইলেন। পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে এখন হাসপাতালে। সংবাদের পেছনে ছোটা দম্পতি এখন নিজেরাই সংবাদ।
সুখের সংসার বলতে যা বোঝায়, সবই ছিল তাঁদের। স্বামী-স্ত্রী দুজনই সাংবাদিক। বিয়ের দুই বছর পর জন্ম নিল তাঁদের একমাত্র মেয়ে। চাঁদের মতো মেয়েটিকে দেখে দুজন মিলে নাম রাখলেন চন্দ্রমুখী।
সেই চন্দ্রমুখী হুট করেই হলো গুরুতর অসুস্থ। সব সুখ উবে গেল মা-বাবার। মেয়েকে ভর্তি করা হলো ঢাকা শিশু হাসপাতালে। মা-বাবার একটাই প্রার্থনা, তাঁদের বুকের ধন যেন সুস্থ হয়ে আবার বুকে ফিরে আসে। কিন্তু ১৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে সব আলো নিভিয়ে চলে গেল চন্দ্রমুখী।
মেয়ের এমন মৃত্যু যেন এলোমেলো করে দিল পুরো সংসার। শোক সইতে না পেরে পাঁচতলা থেকে লাফ দিয়ে মা এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। প্রতিদিন যিনি সংবাদ লেখেন, এখন তিনি নিজেই সংবাদ।

জনকণ্ঠ-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক নাজনীন আখতার আর জিটিভির প্রধান প্রতিবেদক রকিবুল ইসলামের একমাত্র মেয়ে ছিল চন্দ্রমুখী। সহকর্মীরা জানালেন, সব সময় হাসিখুশি থাকায় এই দম্পতিকে সবাই পছন্দ করেন।
নাজনীন আর রকিবুল দুজনই একসময় একই প্রতিষ্ঠানে সাংবাদিকতা করতেন। সেখান থেকেই ভালো লাগা। ২০০৬ সালের ২৬ জুলাই তাঁরা বিয়ে করেন। ২০০৮ সালের ১৭ মে এই দম্পতির ঘর আলো করে এল চন্দ্রমুখী।
গুটি গুটি পায়ে একদিন চন্দ্রমুখী হাঁটা শিখল। কী সুন্দর করে মা-বাবাকে ডাকে। এলোমেলো হাতে আঁকে বাবার ছবি।
এ বছরের জানুয়ারিতে নিজের বাবাকে হারানোর পর মেয়েকে আরও বেশি করে করে আঁকড়ে ধরেন নাজনীন। ১৭ মে চন্দ্রমুখীর জন্মদিনে নাজনীন তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘শুভ জন্মদিন, মা! তোমার কারণেই আমার ভুবন এত আলোয় ভরা। এবার জন্মদিনে তোমার পাশে নানা নেই.. তবে আমি নিশ্চিত, যে ভালোবাসা তিনি তোমার জন্য দেখিয়েছেন, সেই একই ভালোবাসা নিয়ে দূর থেকেও তোমার জন্য আশীর্বাদ করছেন…. সবার দোয়া নিয়ে নিয়ে তুমি ভালো থাকো মা… শতায়ু হও।’
কিন্তু নাজনীনের দোয়া পূর্ণ হয়নি। শতায়ু তো দূরের কথা, পাঁচ পেরিয়ে ছয়ে পা রাখতেই চন্দ্রমুখীও চলে গেছে নানার কাছে।
কিন্তু কী হয়েছিল চাঁদের মতো মেয়েটির? বাবা রকিবুল ইসলাম জানালেন, কিছুদিন ধরে চন্দ্রমুখী লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত ছিল। ১৩ সেপ্টেম্বর গুরুতর অসুস্থ হলে ঢাকা শিশু হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি। কিন্তু মেয়েকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আশায় এতটুকু চিড় ধরেনি নাজনীনের। ১৬ সেপ্টেম্বর হঠাৎ করেই নেমে আসে শূন্যতা।
সেদিন বিকেল চারটার দিকে আশপাশের সবাইকে দেখে নাজনীন বুঝতে পারেন, চন্দ্রমুখী আর নেই। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তিনি চলে যান কল্যাণপুরের বাসার দিকে। বাসার দরজা খুলে কোনো কথা না বলেই পাঁচতলার বারান্দা থেকে লাফ দেন নাজনীন।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সহকর্মীরা জানান, শিশু হাসপাতাল থেকে বাসায় যাওয়ার পথে পুরোটা সময় অস্থির হয়ে চন্দ্রমুখীর গল্প করেছেন নাজনীন। পাঁচতলার বাসার দরজা খুলেই নাজনীন চলে যান বারান্দায়। সঙ্গে থাকা এক সহকর্মী জানতে চান, ‘কই যাও?’ তিনি বলেন, ‘বাসায় আলো—বাতাস আসুক।’ এরপর বারান্দায় গিয়েই রেলিংয়ে দাঁড়িয়ে তিনি লাফ দেন।
কল্যাণপুরের বাসা থেকে গাড়িতে করে দ্রুত তাঁকে নেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। ততক্ষণে হাসপাতালে পৌঁছে গেছেন অন্য সহকর্মীরা। অনেকেই কাঁদছেন। কেউ কেউ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে। নাজনীনের শরীর থেকে তখন রক্ত ঝরছে। ডাক্তারদের চেহারাই বলে দিচ্ছে, রোগীর অবস্থা সংকটাপন্ন। তাঁদের পরামর্শ, এক্ষুনি রোগীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিতে হবে।
নাজনীনকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। অ্যাম্বুলেন্স ছুটে চলে। যানজট পেরিয়ে নেওয়া হয় তাঁকে ঢাকা মেডিকেলে। শুরু হয় অস্ত্রোপচার। রাত ১১টার দিকে তাঁকে নেওয়া হয় হাসপাতালের আইসিইউতে।
প্রিয় মেয়েকে কবরে শুইয়ে মধ্যরাতে হাসপাতালে এলেন রকিবুল। এত শোক সামলাবেন কী করে মানুষটা? চেহারা বিধ্বস্ত। ধীর পায়ে তিনি ঢুকলেন হাসপাতালে। স্ত্রীকে কিছুটা সময় দেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন তিনি। বাইরে তখন সহকর্মীরাও কাঁদছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, নাজনীন বারবার চন্দ্রমুখীর কাছে চলে যেতে চাইছেন। চিকিৎসকদের তিনি বারবার বলেছেন, ‘আমি তো চন্দ্রকে বলেছি, আমি ওর কাছে চলে যাব। আপনারা কেন আমার চিকিৎসা করছেন?’
হাসপাতালের অবেদনবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নাজনীনের সারা শরীরে অসংখ্য আঘাত। মেরুদণ্ডের চার জায়গায়, পায়ের ওপরের দিকে, হাতের কবজিতে ফাটল। পাঁচতলা থেকে লাফ দেওয়া বাঁ দিকের ফুসফুসে আঘাত লেগেছে। সেখানে টিউব লাগানো হয়েছে।

মেয়ে বেঁচে নেই। নাজনীন হাসপাতালে। সদা হাস্যময় রকিবুলের মুখে এখন কেবলই বিষণ্নতার ছায়া। কাছে গিয়ে অনুভূতি জানতে চাওয়ার সাহস নেই। তবে কথায় কথায় রকিবুল নিজেই বললেন, ‘তন্বী (নাজনীনের ডাকনাম) বারবার বলছে, চন্দ্রমুখীকে বলেছিলাম আমাদের ছেড়ে যেয়ো না। ও শুনল না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে রকিবুল বলেন, ‘আমার সাজানো বাগানটা লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।’
মা-বাবার জীবনের সবটুকু আলো যেন চন্দ্রমুখী নিয়ে গেছে। কেবল কি মা-বাবা? স্বজন ও সংবাদকর্মীদের বাইরে যাঁরা নাজনীনকে চিনতেন না, চন্দ্রমুখীর মৃত্যুর পর তাঁরাও চিনেছেন নাজনীনকে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নাজনীনের কোলে চন্দ্রমুখীর ছবি দেখে কেঁদেছেন অনেকেই।
এ বিষয়ে কথা হয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক মেখলা সরকারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সন্তান হারানোর শোক মা-বাবা কখনও ভুলতে পারেন না। আমাদের কোনো সান্ত্বনা বা পরামর্শ হয়তো এ মুহূর্তের কষ্টটাকে কমিয়ে দেবে না। তবে এটুকু বলতে পারি জীবনকে থামিয়ে দেওয়ায় বা জীবনকে শেষ করা ঠিক নয়। কারও না কারও জন্য বেঁচে থাকতে হয়। কেউ না থাকলে নিজের জন্যও বেঁচে থাকতে হবে। জীবনকে এগিয়ে নিতে হবে।’
চন্দ্রমুখীর জন্মদিনের আগে ১৭ মে ফেসবুকে রকিবুল লিখেছিলেন, ‘দেখতে দেখতে পাঁচ বছর হয়ে গেল চন্দ্রমুখীটার। সুস্থ থাকো। অনেক বড় হও। তোমার চোখে যে আকাশ দেখব বাবা… যে আকাশে খেলা করে বেড়াবে সুখের পরতে সাজানো তুলোট মেঘের দল… তুমিই যে আমার হাসি… বেদনা আর বেঁচে থাকার কারণ… আগাম শুভ জন্মদিন চন্দ্রমুখী… বেঁচে থাকো যুগ যুগ… আর কিছু না হও.. একজন ভালো মানুষ হও… তোমার পরিচয়ে যেন পরিচয় হয় আমার… ওই যে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা… ওটা চন্দ্রমুখীর বাবা…।’
মেয়ে মারা যাওয়ার পর ১৯ সেপ্টেম্বর রকিবুল তাঁর একটা ছবি দিয়েছেন ফেসবুকে যেটি চন্দ্রমুখী এঁকেছিল। সেখানে রকিবুল লিখেছেন, ‘পৃথিবীর আর কোনো বিখ্যাত শিল্পী কি পারবে এমন করে বাবার ছবি আঁকতে? আমি জানি পারবে না। শুধু আমার চন্দ্রমুখী যোগ্যতা রাখে এমন হূদয় দিয়ে বাবার প্রতিকৃতি আঁকার।’
রকিবুলের ফেসবুক প্রোফাইলে কভার ছবিতে এখন পূর্ণিমার চাঁদের ছবি যেন সে চন্দ্রমুখী। আর প্রোফাইল ছবিতে শুধুই একরাশ অন্ধকার, কালো শূন্যতা, যেন তাঁর বর্তমান জীবন। রকিবুল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বড় অন্ধকার এক পৃথিবীতে দিশেহারা বাবাকে ফেলে কোথায় টুকি দিলে মিম্মি… আমার যে আর কোনো আলো নেই… হাসি নেই… যখন বড্ড একা লাগবে ছুটে এসে ক্ষতবিক্ষত এই নিঃস্ব বুকে… আগের মতো জড়িয়ে মিষ্টি করে বোলো, ঘুমোব’… অপেক্ষায় আছি.. মধুর ডাকটা শুনব বলে…।