শরিফুল হাসান
মালয়েশিয়াপ্রবাসী তিন থেকে চার লাখ বাংলাদেশির নির্ধারিত সময়ে যন্ত্রে পাঠযোগ্য পাসপোর্ট (এমআরপি) পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সরকারের পক্ষ থেকে দিনে পাঁচ হাজার করে এমআরপি দিতে বারবার তাগাদা দেওয়া হলেও তারা দিনে ৬০ থেকে ৭০টির বেশি দিতে পারছে না। উল্টো এমআরপির জন্য প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ আদায় ও তাঁদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে বিভিন্ন সময়ে এসব অনিয়মের কথা জানানো হলেও কখনোই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মালয়েশিয়ায় এমআরপি দেওয়ার কাজটি পেয়েছিল বাংলাদেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেটাএজ। তারা প্রবাসীদের এমআরপি দিতে মালয়েশিয়ার প্রবাসী-অধ্যুষিত আটটি এলাকায় আটটি আবেদন গ্রহণকেন্দ্র (এআরসি) চালু করে। কিন্তু গত বছরের আগস্টেই ওই কাজ নিয়ে নেয় মালয়েশিয়ার বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইরিস। এরপর তারা বিতারা আবাদ নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, কাজ করছে দীপন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।
মালয়েশিয়ায় ছয় থেকে সাত লাখ বাংলাদেশি আছেন। পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ৩০ জুলাই পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, দূতাবাস থেকে ১ লাখ ২৯ হাজার ২২৬ জনকে এমআরপি দেওয়া হয়েছে। তবে হাইকমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ১ লাখ ৮৯ হাজার এমআরপি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হাইকমিশন থেকে সোয়া লাখ এবং এআরসিগুলো থেকে ৬৫ হাজার এমআরপি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ এখনো তিন থেকে চার লাখ লোকের এমআরপি পাওয়া বাকি আছে। হাতে সময় আছে সাড়ে তিন মাস। এর মধ্যে এত লোকের হাতে এমআরপি পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।
তবে মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সমস্যা সমাধানে তাঁরা চারটি ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র চেয়েছেন। যেখানে শ্রমিক বেশি, সেখানে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র চলে যাবে। হাইকমিশনও এক হাজার লোকের তথ্য ও ছবি তুলতে পারবে। এভাবে প্রতিদিন পাঁচ হাজার এবং মাসে দেড় লাখ লোককে এমআরপি দেওয়া যাবে। তিন মাসে এভাবে সাড়ে চার লাখ লোককে এমআরপি দেওয়া সম্ভব হবে।
সরেজমিন চিত্র: আটটি এআরসির একটি ক্লাং। গত ১৬ জুলাই দুপুর ১২টার পর ওই কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, পুরো কেন্দ্রই খালি। পাসপোর্ট করতে কিংবা ছবি তুলতে কেউ আসেননি। কেন্দ্রের নিচতলার চেয়ারে যিনি বসে আছেন, নাম জানান শামসুল ইসলাম ওরফে হেলাল। বিতারা আবাদ পাসপোর্টের কাজ পেলেও এই হেলাল দীপনের কর্মচারী। ইমরান নামে আরেকজনকে পাওয়া গেল। তিনিও দীপনের কর্মচারী।
এই এআরসির পাশেই একটি বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ। সেখানে ২০-২৫ জন বাংলাদেশিকে দেখা যায়। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এআরসির অবস্থা জানতে চাইলে তাঁরা জানান, এখানে ঘুষ ছাড়া পাসপোর্ট হয় না। কেউ প্রতিবাদ করলে বের করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে এখন আর কেউ এসব কেন্দ্রে আসেন না।
মোখলেছুর রহমান নামে এক বাংলাদেশি জানান, তিনি সেখানে এমআরপি করতে গিয়েছিলেন। ১১৬ রিঙ্গিতের বদলে তাঁর কাছ থেকে ৫০০ রিঙ্গিত (১০ হাজার টাকা) নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখনো তাঁর পাসপোর্ট নেওয়া হয়নি।
এই কেন্দ্রের বিষয়ে হাইকমিশনে খোঁজ নিয়ে আরও ভয়ংকর তথ্য জানা গেল। মাস দুয়েক আগে এই কেন্দ্রের লোকজনের ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালককেও জানানো হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে ক্লাং কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক জিবরান ইবনে আতিকের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মিনহাজ আহমেদ শাফিলের অনুমতি ছাড়া কোনো কথা বলা যাবে না।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে এমআরপি করতে আসা লোকজনের দীর্ঘ সারি দেখা যায়। সেখানেই কথা হয় নোয়াখালীর আবুল বাসারের সঙ্গে। তিনি এর আগে এমআরপি করতে ক্লাং সেন্টারে গিয়েছিলেন জানিয়ে বলেন, ১১৬ রিঙ্গিতের জায়গায় তিনি ২৭০ রিঙ্গিত দেন। এরপর তাঁকে ২০ দিন পর যেতে বলা হয়। কিন্তু ২০ দিন পর গেলে আবার বলা হয় এক মাস পর যেতে। এভাবে হয়রানির কারণে বাধ্য হয়ে তিনি হাইকমিশনে এসেছেন।
কুমিল্লার আবদুর রাজ্জাক, মাদারীপুরের শিবচরের মোহাম্মদ হীরন, হবিগঞ্জের সুরত আলী, নরসিংদীর তোফাজ্জল হোসেনসহ আরও অনেকেই পাসপোর্ট কেন্দ্রগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করলেন। তাঁরা জানান, হাইকমিশনে পাসপোর্ট পেতে টাকা কম লাগে। আবার দুর্ভোগও কম। তাই সবাই এখন এখানেই আসেন।
হাইকমিশন সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের জুনে তিনটি কেন্দ্র থেকে তিন হাজার ৫১৪টি, জুলাইয়ে ছয় হাজার ৬১৯, আগস্টে ১৩ হাজার ৬৫ এবং সেপ্টেম্বরে ১২ হাজার ৩৩৬টি এমআরপি দিয়েছিল ডেটাএজ। অথচ এখন আটটি কেন্দ্র থাকার পরও মাসে দুই হাজারের বেশি এমআরপি দিতে পারছে না বিতারি আবাদি।
গত জুনের শেষে তৎকালীন প্রবাসীকল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন মালয়েশিয়া সফরে গেলে প্রবাসীরা এমআরপি নিয়ে হয়রানি ও আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ করেন। মন্ত্রীও এমআরপির কার্যক্রম দেখে হতাশা প্রকাশ করেন। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে পরে এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেওয়া হয়। এ ছাড়া এআরসি থেকে ফিরে আসা কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাও ঘুষ-দুর্নীতিসহ এমআরপি নিয়ে যে দুরবস্থা চলছে, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে চিঠি দিয়েছেন। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে স্বরাষ্ট্র ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরে দেওয়া সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়েছে, মালয়েশিয়া আউটসোর্সিং কোম্পানির কার্যক্রম খুবই হতাশাজনক। প্রবাসীদের এমআরপি দিতে হলে এ মুহূর্তে ভ্রাম্যমাণ কেন্দ্র পাঠানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই।