উল্টো পথে ছাত্রলীগ

Spread the love

শরিফুল হাসান


আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাসমুক্ত রাখার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর থেকেই শিক্ষাঙ্গনগুলোতে উল্টো সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ছাত্রলীগ। তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার কারণে বছরজুড়েই দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছিল অস্থিরতা। বন্ধ হয়ে যায় বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সারা বছর যেমন নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়ে ছিলেন, তেমনি ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এতে বিঘ্নিত হয়েছে শিক্ষার পরিবেশ।পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, মহাজোট সরকার গঠনের পর এক বছরে ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের একাংশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আসাদ মারা যান। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে মারা যান ছাত্রলীগের নেতা পলাশ জমাদ্দার। এ ছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দলে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাজারখানেক নেতা-কর্মী কমবেশি আহত হন।দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্রশিবির ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গেও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছেন আরও হাজারখানেক নেতা-কর্মী। রাজশাহীতে ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা শিবিরের সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। আহত হন দুই পক্ষের শতাধিক নেতা-কর্মী। অনির্দিষ্টকালের জন্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার ছাত্রলীগের হামলায় মারা গেলেন রাজশাহী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট শাখা ছাত্রমৈত্রীর সহসভাপতি রেজানুল ইসলাম চৌধুরী।ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে টেন্ডার ও চাঁদাবাজির অভিযোগ ছিল বছরজুড়েই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্ত্রসহ ছাত্রলীগের এক নেতার মহড়ার ঘটনা সারা দেশে আলোচিত হয়। এমনকি ছাত্রলীগের হাতে শিক্ষক লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে ছাত্রলীগের অনৈতিক দাবির মুখে গত ১৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।ছাত্রলীগের সাবেক নেতা এবং বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাংসদ—এমন কয়েকজন প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছরে আওয়ামী লীগ সরকার সফল ছিল। কিন্তু সেই সফলতায় কালিমা লাগিয়েছে ছাত্রলীগের নানা অপকর্ম। তারা সরকারের সফলতার পথে না হেঁটে উল্টো পথে হেঁটেছে।তবে এই অভিযোগ মানতে নারাজ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক।আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম গতকাল আবারও শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস সৃষ্টির বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ছাত্র নামধারীদের গুন্ডামি সহ্য করা হবে না।সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও বর্তমান সাংসদ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি বুঝতে পারি না, এখনকার নেতাদের সমস্যা কোথায়! কেন তারা নেতিবাচক কাজ করে? দল ক্ষমতায়, কোনো সমস্যা থাকলে তারা আমাদের বলতে পারে।’ তিনি বলেন, কেউ বিতর্কিত কাজ করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান সাংসদ আব্দুর রহমানেরও একই মত। তাঁর মতে, মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয় এমন কর্মকাণ্ড থেকে ছাত্রলীগের দূরে থাকা উচিত।ছাত্রলীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী বলেন, রাজশাহীতে ছাত্রমৈত্রীর নেতা মারা যাওয়ার ঘটনাটি দুঃখজনক। সারা দেশে ছাত্রলীগের কার্যক্রমের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে আমরা সহাবস্থান নিশ্চিত করেছি। আমরা চাই, সব জায়গায় পড়াশোনার পরিবেশ থাকবে। কিন্তু অনেক ছদ্মবেশী আজ ছাত্রলীগে ঢুকে গেছে। তারা কিছু অপকর্ম করছে। আর পলিটেকনিকসহ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন অনেককেই আমরা চিনি না।’ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা উপদল, প্রায়ই সংঘর্ষ: নির্বাচনের পরদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হল দখল নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরপর সারা বছর বিভিন্ন দল-উপদলে সংঘর্ষ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে একযোগে কয়েকবার তল্লাশি চালায় পুলিশ। কিন্তু অপরাধী নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়নি।ক্যাম্পাসে কর্মরত গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, এক বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সব কটি আবাসিক হলে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে অন্তত দেড় শ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমবেশি আহত হন ৩০০ ছাত্র। জিয়াউর রহমান হল, এস এম হল, জগন্নাথ হল, মুহসীন হল ও জসীমউদ্দীন হলে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়েছে।তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি শেখ সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা যে ঘটেনি, তা নয়। ভবিষ্যতে আর যেন না ঘটে, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ সাকিব বলেন, ক্ষমতার লোভে নতুন অনেকে ছাত্রলীগে যোগ দিয়েছেন। এসব অনুপ্রবেশকারী সমস্যা করছেন।রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়: নির্বাচনের পর থেকেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। সবচেয়ে বড় সংঘর্ষ হয় ১৩ মার্চ। সেদিন ক্যাম্পাস ও আশপাশের এলাকায় ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। মারা যান শিবিরের একজন। এর জের ধরে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), মেডিকেল কলেজ, রাজশাহী কলেজ, নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ, সিটি কলেজ ও প্যারামেডিকেল ইনস্টিটিউট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। বিপাকে পড়েন এসব প্রতিষ্ঠানের ৬০ হাজার শিক্ষার্থী।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়: জাহাঙ্গীরনগরে এক বছরে অন্তত পনেরোবার সংঘর্ষ হয়েছে। এতে দুই শতাধিক আহত হয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে গত বছরের ১৪ জানুয়ারি দুই পক্ষের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। অর্ধশতাধিক কক্ষ ভাঙচুর হয়। ১৬ জানুয়ারি ফের সংঘর্ষে ৩০ জন আহত হন। এসবের জের ধরে গত বছরের ১৮ জানুয়ারি ক্যাম্পাসে এক মাসের জন্য ছাত্রলীগের কার্যক্রম স্থগিত করা হয়।এর মধ্যেও ১৬ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগরে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। সেদিন সংঘর্ষে দুই পক্ষ হকিস্টিক, রামদা, শটগান, ছোট পিস্তল, ছুরি ইত্যাদি নিয়ে পরস্পরের ওপর হামলা চালায়। এতে সাগর নামে একজন গুলিবিদ্ধসহ ১৫-২০ জন নেতা-কর্মী আহত হন। ছাত্রলীগের এই সংঘর্ষের মূল কারণ ছিল, ছাত্রদের জন্য প্রায় সাড়ে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণকাজের দরপত্রের ভাগাভাগি। জাহাঙ্গীরনগরে সর্বশেষ ৭ জানুয়ারি এক সংঘর্ষে ছাত্রলীগের নেতা বিপুল আহত হন।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের বিলুপ্ত কমিটির সভাপতি সোহেল পারভেজ প্রথম আলোকে বলেন, গত এক বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নামধারী কিছু উচ্ছৃঙ্খল কর্মী অস্থিরতা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটিয়েছেন। এ ছাড়া কমিটি না থাকায় কোনো শৃৃঙ্খলা নেই, বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। এখন পরিস্থিতি ভালো বলে দাবি করেন তিনি। সাধারণ সম্পাদক মাহমুদ নাসের বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই এসব সংঘর্ষ হয়েছে। মূল ধারা থেকে বিচ্যুত নেতা-কর্মীরা এসব করেছেন।চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, ইসলামী ও শাহজালালে সংঘর্ষ-উত্তেজনা: তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৩ জুন ছাত্রলীগ ও ছাত্রশিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন আহত হন। ১৯ জুলাই রাতে আবার ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন।উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ফটক ও ভবনে ১৬ জানুয়ারি রাতে তালা ঝুলিয়ে দেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। তাঁরা ৪৭ ঘণ্টা উপাচার্যকে অবরোধ করে রাখেন। ১৫ মে রাতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্রীকে উত্ত্যক্ত করা নিয়ে ৪ এপ্রিল ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে পাঁচজন আহত হন। সংঘর্ষের সময় ছাত্রলীগের কর্মীরা ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলন ও নবীনবরণ অনুষ্ঠানেও হামলা করে তা পণ্ড করে দেন। এর পরও জগন্নাথে চার দফায় ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়েছে।সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ জুন থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। গত বছরের ৫ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। এ ছাড়া নিজেদের মধ্যে বিরোধ তো ছিলই। এ বছরের ৫ জানুয়ারি সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষে ২২ জন আহত হন। রাজনীতিমুক্ত শিক্ষাঙ্গনে রাজনীতি: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি ছিল না। কিন্তু ছাত্রলীগ সেখানেও রাজনীতি শুরু করে। ৩১ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ-সমর্থিত দুই পক্ষে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে ভাঙচুর হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এক মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর ৮ অক্টোবর ফের ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।মেডিকেল কলেজগুলোতেও অস্থিরতা: নির্বাচনের দিন রাতেই পুরান ঢাকার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাসের দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষে আহত হন ১০ জন। ভাঙচুর হয় সাতটি কক্ষ। খুলনা মেডিকেল কলেজের এক নম্বর ছাত্রাবাসে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগ ও শিবিরের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন, ছাত্রাবাসের ১৩টি কক্ষ ভাঙচুর হয়। কর্তৃপক্ষ অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে।৩০ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজে দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। পরদিন কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজে ২৫ এপ্রিল ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষে চারজন আহত হন।আধিপত্যের বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ হতে পারে—এমন আশঙ্কায় ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম মেডিকেল অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়; কিন্তু সংঘর্ষ ঠেকানো যায়নি। ছাত্রলীগ ও শিবিরের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পোড়ানো হয় প্রধান ছাত্রাবাসের ১১টি কক্ষ।মেডিকেল কলেজগুলোর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার বলেন, ‘মেডিকেল কলেজগুলোতে যারা ছাত্রলীগ করে, তাদের প্রতি অনেক সময়ই আমরা লক্ষ রাখতে পারি না। ফলে অনেক সুযোগসন্ধানী ছাত্রলীগে ঢুকে পড়ে।’সরকারি কলেজগুলোতে সংঘর্ষ: খুলনা বি এল কলেজে ৫ জানুয়ারি হল দখলকে কেন্দ্র করে শিবিরের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রলীগ। এতে পুলিশসহ ২০ জন আহত হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ করা হয়। খুলনা সরকারি মজিদ মেমোরিয়াল সিটি কলেজে ১৬ মার্চ ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বাধার মুখে ছাত্রদল মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারেনি। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে ২১ এপ্রিল ছাত্রলীগের দুই পক্ষে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের জিয়া হলে ১৬ মে ছাত্রলীগ-শিবিরের মধ্যে সংঘর্ষের পর হলটি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হয়।নতুন অধ্যক্ষকে স্বাগত জানানোকে কেন্দ্র করে বরগুনা সরকারি কলেজে ৬ জুলাই ছাত্রলীগের দুই পক্ষে সংঘর্ষ হয়। এ ঘটনায় ছাত্রলীগের ১৩ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়। এরপর অধ্যক্ষের অপসারণ দাবিতে ৯ জুলাই ধর্মঘট ডাকে ছাত্রলীগ। রাজবাড়ী সরকারি কলেজ ক্যাম্পাসে ৩০ জুলাই ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় ছাত্রলীগ। ২৯ অক্টোবর রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজে ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষে ১০ জন আহত হন।পলিটেকনিকে সন্ত্রাস: ২ জানুয়ারি রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কয়েক দফা হামলায় ছাত্রদলের ১০ জন কর্মী আহত হন। ছাত্রাবাসের কক্ষ দখল নিয়ে উত্তেজনা ছিল সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে।টেন্ডারবাজি-চাঁদাবাজি: গত বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের ৬১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত পুনর্মিলনী ও আলোচনা সভায় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, খুব শিগগির ছাত্রলীগের সম্মেলন হবে। তিনি ছাত্ররাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও চাঁদাবাজি চলতে দেওয়া হবে না বলে ঘোষণাও দেন। কিন্তু ছাত্রলীগের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে একপর্যায়ে ৪ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ছাত্রলীগের সাংগঠনিক নেত্রীর পদ থেকে সরে যান।জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে ৩১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদাবাজিসহ সব ধরনের নেতিবাচক কাজ থেকে বিরত থাকতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘আমি যখন পত্রিকায় পড়ি, ছাত্রলীগের ছেলেরা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করে, তখন আমার কষ্ট লাগে।’ প্রধানমন্ত্রীর এই আহ্বান ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের কানে যায়নি।২৪ আগস্ট খাদ্য ভবনে দুই কোটি ৮০ লাখ টাকার ঠিকাদারি কাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের বরিশাল ও ফরিদপুর পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। ২৬ আগস্ট মতিঝিলে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) প্রায় দেড় কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজের দরপত্র জমা দিতে বাধা সৃষ্টি করেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী। ২৬ জুলাই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৫০ লাখ টাকার দরপত্র পুলিশের সামনেই ছিনিয়ে নেয় ছাত্রলীগ। তারা এ সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী জাকির হোসেনকে মারধর করে। ২২ মার্চ রাজধানীর সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে চড়াও হয়ে পুলিশের উপস্থিতিতেই দরপত্রের কাগজ ছিঁড়ে ফেলেন ছাত্রলীগের কিছু নেতা। নিজেদের পছন্দমতো প্রার্থী ভর্তি করতে না পারায় ২ এপ্রিল পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে মুক্তিযোদ্ধাসহ অন্যান্য কোটায় সম্মান প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থী ভর্তির প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয় ছাত্রলীগ। একই ঘটনা ঘটে চাঁদপুর সরকারি কলেজে।নড়াইলের সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিল থেকেও ৯ জুলাই চাঁদাবাজি করেন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতারা।প্রভাব খাটিয়ে বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ (শজিমেক) হাসপাতালের রোগীদের বার্ষিক প্রায় দুই কোটি টাকার খাদ্য সরবরাহের কাজ বাগিয়ে নেন বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সুলতান মাহমুদ খান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে গাড়ি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ নজরুল ইসলাম খান নামের ছাত্রলীগের এক কর্মীকে আটক করে। বাংলাদেশ-কুয়েত মৈত্রী হল ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের সংযোগপ্রাচীর নির্মাণকাজের জন্য ঘোষিত ১০ লাখ ৬৯৮ টাকার দরপত্রের শিডিউল জমা দিতে পারেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এম বিল্ডার্স। চারুকলা অনুষদের ছাত্রলীগের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা পদ পাওয়ার দুই দিন পরই নিউমার্কেটের উল্টো দিকে রাজউকের তত্ত্বাবধানে নির্মাণাধীন বহুতল ভবনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিশ্বাস বিল্ডার্সের কাজ বন্ধ করে দেন। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের কাছে এক কোটি টাকা চাঁদা দাবি করেন। পরে এ বিষয়ে আপস হয়। গত ৪ সেপ্টেম্বর নীলক্ষেত মোড়ে একটি মোবাইল ফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের স্থাপন করা বিলবোর্ড ও যাত্রীছাউনি ভেঙে দেন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সভাপতি গ্রুপের কর্মীরা। তাঁরা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেন। এদিকে নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেট থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করছেন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় দুই নেতার সমর্থকেরা।টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগও পিছিয়ে নেই। ওই কলেজের এক নেতার সমর্থকেরা চাঁদাবাজি করতে গিয়ে আশুলিয়ায় টহল পুলিশের হাতে অস্ত্রসহ ধরা পড়েন। তাঁদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগ নিউমার্কেটের সামনের রাস্তা অবরোধ করে। তবে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা চাঁদাবাজির অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সাধারণ সম্পাদক মাহফুজুল হায়দার বলেছেন, ‘ছাত্রলীগের নামে যারা চাঁদাবাজি করছে, তারা আসলে ছাত্রলীগের কেউ নয়। একসময় ছাত্রলীগ করত এমন অনেকেই এসব করছে।’বারবার শুধু আশ্বাস: ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে গত বছরের শুরু থেকেই নানা অভিযোগ ওঠে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা বারবার কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেন। তবে বাস্তবে পুলিশকে ছাত্রলীগের প্রতি কঠোর হতে দেখা যায়নি।কেন এ সংঘর্ষ: ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতা বলেছেন, বিরোধী দলে থাকার সময় খুব কমসংখ্যক নেতা-কর্মীই মাঠে ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর দলে নেতা-কর্মীর অভাব নেই। এর মধ্যে একশ্রেণীর নেতা-কর্মী চাঁদাবাজি ও দরপত্রে অংশ নেওয়ার সঙ্গে জড়িত। তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা উল্টো প্রশ্রয় দিয়েছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে সদস্যসংখ্যা কত, তা কেউ জানে না। ফলে অনেকেই নেতা বনে যাচ্ছেন। নিয়মিত কমিটি না থাকাও এসব অপকর্মের কারণ বলে অনেকের ধারণা।ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা জানান, সংশোধিত গঠনতন্ত্রের ৫ নম্বর ধারার (ক) উপধারায় বলা হয়েছে, অনূর্ধ্ব ২৭ বছর বয়সী বাংলাদেশের যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বা ছাত্রী ছাত্রলীগের প্রাথমিক সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু সারা দেশে ছাত্রলীগের মোট ৮৭টি ইউনিটের মধ্যে ৮৬টির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অধিকাংশের বয়স ২৭ বছরের ঊর্ধ্বে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, যাঁরা ছাত্রলীগের নেতা, তাঁরা ছাত্র নন। ফলে তাঁদের ছাত্রত্ব হারানোর ভয় থাকে না। যা খুশি তা-ই করে বেড়ান।এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘এটা সত্য, ছাত্রলীগের অনেক কমিটিতে এমন অনেকে আছে, যারা ছাত্র নয়। এমনকি অনেককে আমরাও চিনি না। কিন্তু আমরা দুই মাস ধরে সারা দেশ ঘুরে নতুন করে কমিটি করছি। এখন যারা ছাত্র, তারাই ছাত্রলীগ করবে। ফলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে ইতিবাচক রাজনীতি শুরু হবে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published.