ইস্তাম্বুলের রাস্তায়!

Spread the love

শরিফুল হাসান

ইস্তানবুল বিমাবন্দর থেকে নেমে তুরুস্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছি। ঘন্টাখানেক পথ চলার পরেই আমাদের গাড়িচালক জানালেন পথেই মহানবী হযরত মুহাম্মদের (সাঃ) ঘনিষ্ঠ এক সাহাবীর কবর পড়বে। একটু থামতে চাই না কী না? আমার সাথে ফ্রান্সের আরেক বন্ধু বিমানবন্দরেই যার সঙ্গে পরিচয়। খরচ বাঁচাতে দুজন একসঙ্গে গাড়িতে উঠেছি। আমার ইতিবাচক ইশারা বুঝে সেও রাজি হলো।

ততোক্ষণে গাড়িচালক সাহাবী আইয়ুব আনসারির (র) কথা বলতে শুরু করেছেন। তাঁর আসল নাম খালেদ ইবনে যায়েদ ইবনে কুলাইব।মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করলেন তখন মদীনার প্রায় অধিবাসীরা তাকে তাদের বাসায় অবস্থান নেওয়ার অনুরোধ জানালেন। তখন সিদ্ধান্ত হয় যে মুহাম্মদের (সা:) উটকে ছেড়ে দেয়া হবে এবং সেটি যেখানে বসবে সেখান থেকে নিকট বাসায় মহানবী অবস্থান নেবেন। উটটি আবু আইয়ুব আনসারির বাসার কাছে মাটিতে বসে পড়ে। তাই এখানে মুহাম্মদ (সাঃ) এর অবস্থান নেন। এরপর জীবনের শেষদিন পর্যন্ত যুদ্ধ করেছেন ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য। আমি তখন ভাবছিলাম মদীনা থেকে তাঁর কবরটি এখানে এলো কী করে?

গুগল করতেই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। মুসলমানরা একদিন কনস্ট্যান্টিনোপল বিজয় করবেন মৃত্যুর আগে সেই ভবিষ্যদ্বাণী করে গিয়েছেন নবীজী(স.)। মুসলিম বাহিনী যখন কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান তুরস্কের ইস্তাম্বুল) বিজয়ের জন্য সশস্ত্র অভিযান শুরু করে আইয়ুব আনসারি তখন ৮৬ বছরের বৃদ্ধ। তাকে সবাই এই অবস্থায় যুদ্ধে যেতে না করেন। কিন্তু নবীজীর (স.) ভবিষ্যৎবানীর গর্বিত অংশীদার হতে তিনি এই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য অনড় থাকেন এবং শেষে সবাই মেনে নেন।

কিন্তু যুদ্ধের ময়দানেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। সহযোদ্ধারা জানতে চাইলেন শেষ ইচ্ছার কথা। আইয়ুব আনসারি জানালেন, ‘যদি এই যুদ্ধে কনস্ট্যান্টনোপল জয় না-ও হয়, আর তিনি মারা যান তাহলে যেন কনস্ট্যন্টিপোলের যতো কাছাকাছি সম্ভভ কবর দেওয়া হয়। কনস্ট্যান্টিনোপলের ঢোকার পথের ওপর যেন তাকে দাফন করা হয়, যাতে বিজয়ী মুসলিম সৈনিকরা তার কবরের ওপর দিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে রোমান রাজধানীতে ঢুকতে পারে। ৬৭৪ সালে তিনি মারা গিয়েছিলেন।

মুসলিম সৈনিকরা কনস্ট্যান্টিনোপলের দেয়ালের কাছেই তাকে দাফন করেন। আর এভাবেই মদিনার বনু নাজ্জার বংশোদ্ভূত আবু আইয়ুব আনসারির কবর হয়েছিল তুরস্কের ঐতিহাসিক শহর ইস্তাম্বুলে। তুরস্কে তিনি পরিচিত আয়ুপ সুলতান নামে। আইয়ুবকে সেখানে দাফনের সাড়ে সাতশ বছর পর ১৪৫৩ সালে ওই সড়কের ওপর দিয়েই অটোমেন সুলতান দ্বিতীয় মেহমুতের বিজয়ী বাহিনী ইস্তাম্বুলে ঢুকেছিল। আর এভাবেই পূরণ হয় আইয়ুব আনসারি (রা.) স্বপ্ন। পরে সুলতান মেহমুতের এক শিক্ষক আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) সমাধিটি আবিষ্কার করেন।

১৪৫৮ সালে সুলতানের উদ্যোগে একটি অলংকৃত সমাধি এবং পরে আইয়ুপ সুলতান মসজিদ বানানো হয়। এলাকাটি তার নামে পরিচিতি পায়। এটি ইস্তানবুলের আয়ুপ জেলায় পড়েছে। সমাধিটি চিহিৃত হবার আবিষ্কারের পর থেকে হজরত আবু আইয়ুব আনসারি (রা.) এর সমাধি বিশ্ব মুসলিমদের জন্য পবিত্র স্থান হয়ে ওঠে। পুণ্যার্থীদের ভিড় থাকে বছরজুড়ে। গতবছর তুরুস্ক সফরে আমি ওই কবরের সামনে গিয়ে দোয়া করেছি এবং মসজিদে নামায পড়েছি। আবু আনসারির কবরে যাওয়ার পথে দুই পাশে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ। পাহাড় টিলার ওপর পাথরে বাঁধানো শত শত নতুন-পুরোনো সমাধি।

এর মধ্যে ওসমানীয় সাম্রাজ্যের অনেক শাসক ও পরিবারের সদস্য এবং কর্তাব্যক্তির কবর এখানে। এটি ইস্তাম্বুলের প্রাচীনতম এবং বৃহত্তম কবরস্থানে। আইয়ুব আনসারির (রা.) কবরের ভেতরের জায়গাটা দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত। ভেতরে মার্বেল পাথরের গায়ে খচিত মহানবীর (সা.) পায়ের ছাপসহ কিছু ব্যবহার্য জিনিসপত্র আছে। অটোমেন যুগের প্রতিটি প্রজন্মের শাসক এবং অনেক দানশীল ব্যক্তি এই সমাধির অলংকরণ আর সৌন্দর্য বাড়াতে কাজ করেন।

এই কবর এবং পাশের মসজিদকে কেন্দ্র করে অনেক খোলা জায়গা। অটোমেন সুলতানদের সিংহাসনে আরোহণের উৎসবস্থল ছিল এই পবিত্র জায়গাটি। এই পবিত্র জায়গায় এসে দোয়া করে সংসার জীবন শুরু করাকে অত্যন্ত বরকতময় মনে করেন তুরস্কের নবদম্পতিরা।

২০১২ সালে মুক্তি পাওয়া ফেতিহ ১৪৫৩ নামক তুর্কি চলচ্চিত্রে আবু আইয়ুব আনসারিকে একটি চরিত্র হিসেবে দেখানো হয়েছে। আপনারা কেউ কখনো ইস্তাম্বুল ভ্রমণে গেলে জায়গাটি ঘুরে আসতে পারেন। ইস্তাম্বুল নানা কারণে ঐতিহাসিক শহর। এটি বিশ্বের শহরগুলোর মধ্যে বিরলও বটে। কারণ, শহরটি একই সঙ্গে এশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য) এবং ইউরোপের অংশ। একসময় রোমান এম্পায়ার বা বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল এই শহর, তখন এর নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। পরবর্তী সময়ে এটি অটোমান সাম্রাজ্যেরও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। পরে মুসলমানরাও জয় করে এই শহর। এর পরতে পরতে ইতিহাস।কখনো সময় পেলে বেড়াতে যেতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.