পিছু হটবেন না আইভী
শরিফুল হাসান
শামীম ওসমান, নাকি সেলিনা হায়াত আইভী? শেষ পর্যন্ত মেয়র হিসেবে কে পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন? একজন দলের সমর্থন পেলে অপরজন কি সরে দাঁড়াবেন?নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন সামনে রেখে সাধারণ ভোটার ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে এসব প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। গতকাল রোববার শেষ দিনে দুই প্রার্থীই মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানান, আইভীর ব্যাপক জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও শামীম ওসমানের প্রতিই দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ঝোঁক বেশি। কিন্তু দলীয় মনোনয়ন না পেলে আইভী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।সেলিনা হায়াত আইভী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের জনগণ আমার সঙ্গে আছে। আমি এই জনগণকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই।’ অন্য কোনো দলের সমর্থন পেলে নেবেন কি না, জানতে চাইলে আইভী বলেন, ‘আমি মনে করি না অন্য কোনো দলের সমর্থনের প্রয়োজন আছে। আমার বাবা আলী আহমেদ চুনকা কখনো দল ছেড়ে যাননি। বরং দলের বিপদে তিনি যেমন ছিলেন, আমিও তেমন থাকব। আমরা কখনো দলের বিপদে পালিয়ে যাব না।’ দলের মনোনয়ন না পেলে নির্বাচন করবেন কি না, জানতে চাইলে আইভী বলেন, ‘দলীয় সমর্থন পাওয়ার ব্যাপারে আমি পুরোপুরি আশাবাদী। দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলেই আমি নির্বাচন করতে এসেছি। আর দলের মনোনয়ন না পেলে কী করব, তা বলার সময় এখনো আসেনি।’সাবেক সাংসদ শামীম ওসমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘তৃণমূলের নেতারা আমার সঙ্গে আছে। আর তাই দল আমাকে মনোনয়ন দেবে বলে আশা করি।’ তাঁর ঘনিষ্ঠ একজন নেতা বলেন, অতীতে ভাবমূর্তি যা-ই থাক না কেন, শামীম ওসমান এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন পাচ্ছেন বলে নিশ্চিত। কেন্দ্র থেকে সেরকম আভাসই দেওয়া হয়েছে। শামীম ওসমান ও আইভীর দ্বন্দ্বে শেষ মুহূর্তে কী হতে পারে, জানতে চাইলে শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস, কেন্দ্র নারায়ণগঞ্জের বাস্তব অবস্থা চিন্তা করেই আইভীকে মনোনয়ন দেবে। কারণ, এখানে তাঁর কোনো বিকল্প নেই। আর দল যদি মনোনয়ন না-ও দেয়, এ ক্ষেত্রে সরে আসার কোনো উপায় নেই। কারণ, নির্বাচন করার ব্যাপারে সাধারণ মানুষের প্রচণ্ড চাপ রয়েছে এবং আইভী নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কাজেই আমাদের পিছু হটার কোনো উপায় নেই। তবে নির্বাচনে যা-ই হোক, আইভী কখনোই দল ছেড়ে যাবেন না।’শহর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ হায়দার আলী বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জের সাধারণ মানুষ এই নির্বাচনে সেলিনা হায়াত আইভীকেই চায়। দল মনোনয়ন না দিলেও সাধারণ মানুষের ভালোবাসা নিয়ে তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়ে আসবেন, এই বিশ্বাস আমাদের আছে। কাজেই তাঁর নির্বাচন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগই নেই।’শামীম ওসমান ও আইভীর এই দ্বন্দ্বে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সাবেক সাংসদ এস এম আকরাম। তিনিও গতকাল বিকেল পাঁচটায় একেবারে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপত্র জমা দেন। তিনি চাইছেন, শামীম ওসমান ও আইভীর দ্বন্দ্বের মাঝখানে শেষ মুহূর্তে তাঁকে বেছে নেওয়া হোক। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘দল যদি আমাকে সমর্থন না দেয়, তাহলে আমি প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেব।’সিটি নির্বাচনে বিএনপির একক প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন তৈমুর আলম খন্দকার। আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্বের কারণে এই নির্বাচনে তিনি জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার সব ক্ষেত্রে ব্যর্থ। কাজেই মানুষ তাদের বিরুদ্ধে রায় দেওয়ার জন্য বসে আছে।’এই চারজনের বাইরে মেয়র হিসেবে গতকাল মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন ইসলামী আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি আতিকুল ইসলাম নান্নু মুন্সি, আওয়ামী ওলামা লীগের বহিষ্কৃত সভাপতি হাবিবুল্লাহ কাঁচপুরী এবং স্বতন্ত্র হিসেবে আতিকুল ইসলাম জীবন ও শরিফ আহমেদ। উৎসবমুখর পরিবেশ: মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল কাল। সকাল নয়টা থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত শহরের চাষাঢ়ায় শহীদ জিয়া হল মিলনায়তনে সম্ভাব্য প্রার্থীরা এসে মনোনয়নপত্র জমা দেন। সারা দিন পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। ছিল কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থাও। প্রার্থী ও প্রার্থীদের সঙ্গের লোক ছাড়া অন্য কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। তবে জিয়া হলের বাইরে ছিল উৎসুক মানুষের ভিড়।বেলা সাড়ে ১১টায় মনোনয়নপত্র জমা দিতে আসেন বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না, তা নিয়ে নারায়ণগঞ্জবাসীর মধ্যে শঙ্কা আছে। তাই আমরা সেনা মোতায়েনের দাবি জানাচ্ছি।’বেলা দুইটা ২০ মিনিটে আইভী জিয়া হল মিলনায়তনে আসেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক নিজামউদ্দিন, জেলা যুবলীগের সভাপতি আবদুল কাদির ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহসভাপতি রফিউর রাব্বি।উপস্থিত সাংবাদিকদের আইভী বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশের বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে। তার পরও নির্বাচন কমিশন যদি মনে করে তারা কঠোর অবস্থানে থেকে একটি সুস্থ নির্বাচন করবে, তাহলে আমার আর কিছু বলার নেই। আর সেনাবাহিনী মোতায়েনের বিষয়টি নারায়ণগঞ্জবাসীর দাবি। আমার মনে হয়, সেনা মোতায়েন থাকলে মানুষ অনেক আশ্বস্ত হবে।’ এরপর নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে জিয়া হলে প্রবেশ করেন শামীম ওসমান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক মফিজুল ইসলাম, সাবেক সাংসদ গোলাম মোর্শেদ ফারুকী, জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য আনিসুর রহমান ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সস্পাদক খোকন সাহা।সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শামীম ওসমান বলেন, ‘এই নির্বাচন হবে অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ। কোনো যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা হবে না। এটি হবে উৎসব উৎসব খেলা। জনগণ যে রায় দেবে, আমি তা মেনে নেব।’সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ঢাকা বিভাগীয় উপনির্বাচন কমিশনার বিশ্বাস লুৎফর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশে প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র জমা দিচ্ছেন, আমি অভিভূত।’ তিনি জানান, মেয়র পদে আটজন, কাউন্সিলর পদে ২৭৮ জন ও সংরক্ষিত নারী আসনে কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১২ অক্টোবর। ভোট গ্রহণ ৩০ অক্টোবর।