শরিফুল হাসান
আদমশুমারি নিয়ে কয়েকটা কথা! বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন এটা নিয়ে কেউ কেউ দেখলাম সন্দেহ প্রকাশ করছেন। কোন তথ্য বা গবেষণার ভিত্তিতে এই সন্দেহ সেটা অবশ্য এখনো কোথাও চোখে পড়েনি। আমি শুধু একটা তথ্য যোগ করি, আমাদের প্রায় এক কোটি প্রবাসী দেশের বাইরে আছেন যাদের সংখ্যা কিন্তু আদমশুমারিতে থাকে না।
এমনকি যারা বিদেশে চলে গেছেন স্থায়ীভাবে কিংবা লেখাপড়া করতেও তাদের সংখ্যাও শুমারিতে যোগ হয় না। ফলে ১৬ কোটি ৫১ লাখের তথ্যটা আমার স্বাভাবিক লেগেছে।আমি যতোটা জানি আদমশুমারি যখন করা হয় ওই সময়টাতে দেশে থাকা লোকজনকেই শুধু শুমারিতে যোগ করা হয়। সেই হিসেবে দেশের জনসংখ্যা সাড়ে ১৭ কোটি বা তার কম বেশি। তাহলে এই সংখ্যা নিয়ে সন্দেহের কারণটা কী?
আরেকটি তথ্য, ১৪ জুন দিবাগত রাতে যে যেখানে উপস্থিত ছিলেন সে সেখানে গণনাভুক্ত হবেন। ধরেন আপনি ১৪ জুন রাতে আপনার নানার বাসায় বেড়াতে গেছেন এবং সেখানে রাত্রিযাপন করেছেন, তাহলে আপনি সেখানেই গণনাভুক্ত হবেন।
আমি চাকরিসূত্রে রাজশাহী গেলে এবং ১৪ তারিখ রাতে রাজশাহী থাকলে এখানেই গণনাভুক্ত হবো। কোন একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকে, তাহলে সে তার নিজ বাড়িতে গণনায় অন্তর্ভুক্ত না হয়ে প্রাতিষ্ঠানিক খানায় অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই সময় যদি কেউ দেশের বাইরে থাকে সেটা হোক স্থায়ীভাবে চলে যাওয়া, প্রবাসী বা পড়তে যাওয়া তাদের সংখ্যা শুমারিতে যোগ হয় না বলেই আমি জানি। তবে মোট কত প্রবাসী সেটা জানতে প্রবাসীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তবে সেটা আদমশুমারিতে যুক্ত হয়নি।
গত ১৫ জুন একযোগে শুরু হয় জনশুমারি ও গৃহগণনা কার্যক্রম। গত ২১ জুন জনশুমারি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জেলায় বন্যা শুরু হওয়ায় এসব জেলায় শুমারি কার্যক্রম ২৮ জুন পর্যন্ত চলে। এই সময়টায় যারা দেশে ছিলেন শুধু তাদেরই সংখ্যা শুমারিতে এসেছে। আরেকটা তথ্য দেই।
২০১১ সালের পঞ্চম জনশুমারিতে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৯৮ লাখ। জনসংখ্যাবিদদের মতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৩২ থেকে ৩৩ লাখ নতুন শিশু জন্ম নেয়। এক বছরে শিশুসহ প্রায় আট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এই হিসাব অনুযায়ী, দেশে মোট জনসংখ্যার সঙ্গে প্রতিবছর ২৪ থেকে ২৫ লাখ মানুষ যুক্ত হয়। সেই হিসেবে গত এক দশকে প্রায় আড়াই কোটি মানুষ নতুন করে যুক্ত হওয়ার কথা।
আদমশুমারি বলছে, গত এক দশকে দেশে জনসংখ্যা বেড়েছে দুই কোটি ১১ লাখ ১৪ হাজার ৯১৯ জন। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?প্রাথমিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২। ২০১১ সালের জনশুমারিতে গড় জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৭। তার মানে তো ঠিকই আছে। আরেকটা বিষয়। দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে পুরুষ ৮ কোটি ১৭ লাখ ১২ হাজার ৮২৪ জন। নারী ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৪৭ হাজার ২০৬ জন।
অর্থাৎ গত দশ বছরে দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এটিও একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। জনশুমারিতে দেখা গেছে, হিজড়ার সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯ জন। তার মানে সংখ্যাটা যেহেতু খুব বেশি নয়, এই জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা করে কিছু করা অসম্ভব নয়।জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানেই অতিথি জনসংখ্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেছেন, বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশে পুরুষের চেয়ে নারীর সংখ্যা বেশি। মূলত মেয়েদের জীবনের আয়ুষ্কাল বেশি বেশি।
আর দেশ থেকে এক কোটিরও বেশি মানুষ বিদেশে গেছে যার বেশিরভাগই পুরুষ। যাই হোক, আমি যতটা জানি আগামী তিন মাস যাচাই-বাছাই করে (পিইসি) তারপর চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। তার মানে আজকে যা প্রকাশ করা হয়েছে তার সাথে কিছু এদিক সেদিক হতে পারে। তবেযাদের বাড়িতে কেউ যায়নি তাদের তথ্য কীভাবে নেওয়া হবে বা সংখ্যাটা কতো আমার জানা নেই।
পরিসংখ্যান ব্যুরো সেটা ভালো বলতে পারবে। আমি বরং আজকে অন্য কয়েকটা বিষয় নিয়ে বলি। এবারেরশুমারিতে দেখা যাচ্ছে, হিন্দু জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় এক শতাংশ কমে গেছে। এবারের শুমারিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ। একটু পেছনে ফিরেন। ১৯৪৭ সালে যারা ছিলো ৩৩ শতাংশ আজ সেটা হয়েছে আট শতাংশেরও কম। একদিন শুনবেন নামতে নামতে প্রায় শূন্য হয়ে গেছে।
এটা কখনোই একটা দেশের জন্য মঙ্গলজনক নয়। বরং যতো বেশি বৈচিত্র্য থাকবে ততোই একটা দেশের জন্য সুন্দর। এবারের শুমারি অনুসারে, দেশের মোট জনসংখ্যার ১১ কোটি ৩০ লাখ ৬৩ হাজার ৫৮৭ জন গ্রামের বাসিন্দা। আর শহরের বাসিন্দা পাঁচ কোটি ২০ লাখ নয় হাজার ৭২ জন। এই যে এখনো বিপুল সংখ্যাক লোক গ্রামে বাস করে কাজেই শহরগুলোকে এখন পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা যায় কী না ভাবা উচিত।
এখুনি পরিকল্পনা নেওয়া উচিত যাতে একদিন শহরের লোক ১১ কোটি আর গ্রামের পাঁচ কোটি না হয়ে যায়। তাহলে শহরগুলো আরো নরকে পরিনত হবে। এবার আসি শিক্ষা নিয়ে। এবারের আদশুমারি অনুযায়ী, স্বাক্ষরতার হার বেড়ে হয়েছে ৭৪ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগের শুমারিতে ছিল ৫১ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এক দশকে স্বাক্ষরতার এই হার কীভাবে বাড়লো সেটা নিয়ে আমার আরো জানার আগ্রহ আছে।
আমি মনে করি করোনা মহামারির মধ্যে শিক্ষার যে ক্ষতি হয়েছে সেটা কাটিয়ে উঠতে না পারলে আমাদের অগ্রযাত্রা থমকে যাবে। তথ্য প্রযুক্তি নিয়ে বলি এবার। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাঁচ বছরের ঊর্ধ্বে মুঠোফোন ব্যবহারকারী এখন ৫৫ দশমিক ৮৯ শতাংশ। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আরেকটা বিষয়, ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৩০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। এর মানে দেশের এক তৃতীয়াংশেরও কম লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তাহলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার যে কয়েকদিন আগে বলেছিলেন, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা চার কোটি থেকে বেড়ে ১৮ কোটিতে পৌঁছেছে সেটি হয়তো সত্য নয়।
মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার গত মাসে মানে ১৯ মে হুয়াওয়ে এশিয়া প্যাসিফিক ইনোভেশন কংগ্রেস-২০২২ অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত প্রবন্ধে জানিয়েছিলেন, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা চার কোটি থেকে বেড়ে ১৮ কোটিতে পৌঁছেছে। কোথায় কীভাবে এই তথ্য পেলেন তিনি সেটা এখন জানাতে পারেন। আচ্ছা মোট জনগোষ্ঠীর চেয়ে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেশি হয় কীভাবে? শেষ করি দারুণ আশাবাদ দিয়ে। প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক।
আদমশুমারি অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশেরও বেশি জনগোষ্ঠীর বয়স ৫০ বছরের নিচে মানে দারুণ কর্মক্ষম। ৪০ এর নিচে জনগোষ্ঠী ৭০ শতাংশ। আর ৩০ এর নিচের জনগোষ্ঠী ধরলে ৬০ শতাংশ। এর মানে বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশের বয়স ৩০ এর নিচে। আমি মনে করি এটাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।
কয়েকদিনে আগে লিখেছিলাম, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং সব অর্জনেই মূল ভূমিকা ছিল তারুণ্যের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আর প্রযুক্তির এই সময়েও ভরসা তরুণেরাই।
২০৪১ সালে বাংলাদেশের যে রূপকল্প, সেটি অর্জন করতে হবে তারুণ্যের শক্তি দিয়ে। কাজেই তাদের কথা শুনতে হবে, তাদের কথা ভাবতে হবে। আসলে আমরা সবাই মিলে যদি কাজ করতে পারি, আমাদের তারুণ্যকে কাজে লাগাতে পারি প্রবীনের অভিজ্ঞতা আর পরামর্শে এই দেশ আগাবেই। অবশ্য এজন্য উন্নয়নের পাশাপাশি বা উন্নয়নের চেয়েও বেশি জরুরী সুশাসন আর মানবিক মূল্যবোধ।
এই যে সবকিছু নিয়ে সন্দেহ তাঁর কারণ এই সুশাসনের অভাব। আশা করছি আমাদের নীতি নির্ধারকেরা বুঝবেন। সবাই মিলে নিশ্চয়ই আমরা একটা সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে পারবো।